প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতুর স্বপ্ন এখন আর স্বপ্ন নয়। পদ্মা নদীর ওপর প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু এখন পূর্ণ অবয়বে দৃশ্যমান।আজ উদ্বোধনের অপেক্ষায়। যারা বলেছিলেন পদ্মার বুকে সেতু হবে না, তারা আজ দেখে যাক—বাঙালি পারে। যেদিন বিশ্বব্যাংক মিথ্যা অপবাদ দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে এসেছিল, সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে। পদ্মা সেতু আজ বাস্তব। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে ভিন্ন এক পরিচিতি। বিশ্ববাসী জেনেছে বাঙালি তথা বাংলাদেশিদের সক্ষমতার কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব, দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা, সাহসিকতা ও প্রজ্ঞার কারণেই দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে পদ্মার বুকে নির্মিত হলো সেতু।
এটি কি শুধুই সেতু? মোটেও নয়—এটি বাঙালির সক্ষমতার প্রতীক। একসময়ের স্বপ্নের সেতু এখন দৃষ্টিসীমায় দিগন্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মার তীর থেকে দেখা যাচ্ছে পিলারের দীর্ঘ সারি। পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৭ কোটি মানুষের হূদয়ের আবেগ, আশা ও অনুভূতি। চ্যালেঞ্জকে জয় করার অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রমাণ এই পদ্মা সেতু। নির্মিত সেতুটি উন্মুক্ত করেছে দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের দুয়ার। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর সরে যায় আন্তর্জাতিক আরো তিনটি সংস্হা; এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। পরের ইতিহাস আমাদের জানা। কথায় আছে ‘রক্ত কথা বলে’। সাহসী পিতার সাহসী কন্যা সব বাধা উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ নেন। কেটে যায় জাতির ভাগ্যাকাশের কালো মেঘের ঘনঘটা। দিগন্ত আলোকিত করে বাংলার আকাশে হেসে উঠে বিজয়ের সূর্য। সেতু নির্মাণের কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে শুরু হয় স্বপ্নের বীজ বোনা। পদ্মা সেতুর স্বপ্নকে যারা বাস্তব রূপ দিতে চাননি, যারা চক্রান্ত করেছিলেন, দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন তারা স্তব্ধ হয়ে যান ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। ঐ দিন কানাডার অন্টারিওর সুপিরিয়র কোর্ট অব জাস্টিসের বিচারক আয়ান নর্ডেইমারের রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হয়। ভেস্তে যায় কুচক্রীদের সব ষড়যন্ত্র। স্বপ্নের পদ্মা সেতু যেমন আজ বাস্তব, ঠিক তেমনি বাস্তব কানাডার ডাউন টাউন টরন্টোর ৩৬১ ইউনিভার্সিটি অ্যাভিনিউয়ের ২৪১ নম্বর কক্ষে সংরক্ষিত ফাইল নম্বর ৩-৯০০০০৭২৭-০০০০। কারণ এই ফাইলটিই পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির বানোয়াট অভিযোগ খণ্ডনের সাক্ষী বহন করছে। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে দেশি-বিদেশি খলনায়কগণ এই ভেবে নিশ্চিত ছিলেন যে, পদ্মা সেতুর নিমার্ণ পরিকল্পনা কখনই আলোর মুখ দেখবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। তিনি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
বাঙালি যে দুর্জয়কে জয় করতে পারে, যে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, বাংলাদেশেরও যে সক্ষমতা রয়েছে, বাংলাদেশ যে এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, সেটা প্রমাণে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধুকন্যার অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফলে ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর শুরু হয় পদ্মা সেতুর কাজ। ২০১৮ সাল সেতু নিমার্ণ পরিসমাপ্তির সময়সীমা ধরা হলেও সেতুর নকশা সংশোধন, বন্যা, ভাঙনসহ নানা কারণে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। দেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর ভূমিকা নিয়ে এর আগে বিশ্ব ব্যাংক বলেছিল, সেতুটি বাস্তবায়িত হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। প্রতি বছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। এর মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন ঘটবে। বিনিয়োগ বাড়বে। ২১ জেলার কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। তাদের উত্পাদিত পচনশীল পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্হানে পাঠাতে পারবেন। এতে পণ্যের ভালো দাম পাওয়া যাবে। রাতের পর রাত আর কাউকে ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে না। সামগ্রিভাবে দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হবে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়াতে মোংলা বন্দর ব্যবহার করা যাবে। পদ্মা সেতুর যোগাযোগ সুবিধাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে পদ্মার ওপারে ছোটবড় শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতুসংলগ্ন জাজিরার নাওডোবা এলাকায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি গড়ে তোলা হচ্ছে। পদ্মা সেতুসংলগ্ন মুন্সীগঞ্জের লৌহজং, মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ী, চর জানাজাত ও শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ফলে এসব এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।
পদ্মা সেতুর মতো একটি বড় প্রকল্প বাংলাদেশের পক্ষে একা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলে যারা ধরে নিয়েছিলেন, তারা আজ অবাক বিস্ময়ে দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে কল্পনা আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এ সফলতা সহজে আসেনি। আর্থিক সংকট, আর্থিক ব্যবস্হাপনায় চ্যালেঞ্জ, বিশ্বাস, মনোবল ইত্যাদি ছাড়াও বহুবিধ অপ্রত্যাশিত সমস্যা সামাল দিতে হয়েছে সরকারকে। অবশেষে প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল, প্রজ্ঞা ও সততার কাছে হার মেনেছে সব বাধাবিপত্তি। আবারও প্রমাণিত হলো, বাঙালি যেমন স্বপ্ন দেখতে জানে, তেমনি জানে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। একদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার। তার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা মুক্ত, স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক। আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখেছেন উন্নত বাংলাদেশের। তারই ধারাবাহিকতার ফসল পদ্মা সেতু। যা আজ বিশ্বের বুকে বাঙালির সক্ষমতার জানান দিচ্ছে। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গর্বিত দেশ ও দেশের মানুষ। তিনি বিশ্বের আট শত কোটি মানুষকে দেখিয়েছেন ‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হূদয়ে, হবেই হবেই দে