ফয়সাল আহমেদঃবঙ্গবন্ধু সব সন্তানকেই পিতা হিসেবে তার আদর ভালোবাসা দেয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু রাজনীতি তার জীবনের ব্রত ছিল। আন্দোলন-সংগ্রাম, কারাগার যার ছিল
একেবারেই অবধারিত। তার পক্ষে সন্তানদের কাছে দিন কাটাবার সময় ছিল না। বেগম মুজিব সেটি অনেকটাই যেন পুষিয়ে দিতেন। তবে বাড়িতে ভাইবোনদের
মধ্যে ছিল ভীষণ রকমের আনন্দঘন পরিবেশ।
বড় ছোট সব ভাইবোনই যেন একে ওপরের খেলার সাথি, আড্ডার বন্ধু, দেখভালে একে ওপরের প্রতি মানবিক। কেউ কাউকে ছাড়া যেন বাড়িতে শূন্যতা অনুভব
করতেন। ‘হাসু আপা’ ফিরে এলে অন্যরা নানা বায়না ধরতেন। কামাল ফিরে এলে বাড়িতে যেন আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিত। কামাল সবাইকেই ডেকে মজা
করত। জামাল কিছুটা রাশভারী ছিল। তারপরও বাসায় সবাই ভাইবোন ও বন্ধুত্বের আচরণ দেখা যেত। শেখ রেহানাকে বড়রা আদরে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করত।
সবার ছোটো রাসেল আসার পর পরিবারে যেন ওকে নিয়েই কাড়াকাড়ি লেগে থাকত। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি ১৯৬২ সালের পর থেকে এভাবেই বঙ্গবন্ধুর
সন্তানদের নিজস্ব জগতে ভরে ওঠে। তখন অবশ্য বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির জীবন ভয়ানক রকম এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। ৬ দফার আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি
তখন জেলে। এরপরও পরিবারের সন্তানগুলো নানা সংগ্রাম, নানা অপূর্ণতার মধ্যেও মাকে কেন্দ্র করে বাসায় নিজেদেরকে মাতিয়ে রাখত।
লেখাপড়া, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিকচর্চা এবং বাইরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা একে একে ঘটতে থাকে। শেখ রেহানা এমন পরিবেশেই শিশু এবং কিশোরীকাল অতিক্রম
করছিলেন। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মায়ের সঙ্গে ৯ মাস বন্দিজীবন কাটালেন। বাবা ফিরে আসার পর ৭২ থেকে আবার লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করলেন। ৭৫ সালে
বড় বোন শেখ হাসিনা যখন দুই সন্তানকে নিয়ে জার্মানিতে অবস্থানরত স্বামীর সঙ্গে কিছুদিন থাকতে গেলেন। সঙ্গে ছোট বোন রেহানাকেও নিয়ে গেলেন।
১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড বঙ্গবন্ধু পরিবারের জন্যই নয়, গোটা জাতির জীবনেও এক কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। শেখ রেহানা সেই সময়
বড় বোনের সঙ্গে ইউরোপে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। দেশে থাকলে মৃত্যুর তালিকায় তার নামও হয়ত আমাদেরকে এখন বহন করতে হতো। প্রবাসে
বসে দুইবোন ১৫ আগস্টের খবরে শুধু সর্বহারা মানুষের মতো ভেঙে পড়েননি। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছিল। সেটি ছিল
এক বেদনা ও মর্মস্পর্শী জীবন সংগ্রামের অধ্যায়।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমোদনে শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া দিল্লিস্থ ভারতীয় আণবিক শক্তি কমিশনের অধীনে আণবিক খনিজ
বিভাগে ১৯৭৫ সালের ৩ অক্টোবর যোগদান করেন। শেখ রেহানা বড়বোনের সঙ্গে দিল্লিতে চলে আসেন। এখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা
হিসেবে ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন, এবং তা লাভ করেন।
কারণ সেই সময় বাংলাদেশের সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যার কাউকেই দেশে ফিরতে দেয়নি। এই অবস্থায় শেখ রেহানাকে লন্ডনে
চলে যেতে হয়। সেখানে তার জীবন বেশ অর্থকষ্টে কাটছিল। একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে তার
বিয়ে হয়। শফিক সিদ্দিক সেই সময়ে সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত ছিলেন। সেখানেই তারা থাকতেন। তাদের সংসারে ৩ সন্তান জন্মগ্রহণ করে।
রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ১৯৭৮ সালের ২১ মে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। রেহানা সিদ্দিক পরিবারের সন্তান টিউলিপ সিদ্দিক লন্ডন কিংস
কলেজ থেকে পলিটিক্স, পলিসি এবং গভর্নমেন্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাদের আরেক সন্তানের নাম আজমিনা সিদ্দিক। শেখ রেহানা লন্ডনে তিন
সন্তানের লেখাপড়ার সব দায়িত্ব মা হিসেবে যত্ন সহকারে পালন করেন। টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের লেবার পার্টির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। তিনি
২০১৫-১৭ সালে ব্রিটেনের পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
তিনি সরাসরি রাজনীতিতে না থেকেও সরকারকে নানা ধরনের গবেষণাভিত্তিক তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে সহযোগিতা করছেন, একইসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ে নানাভাবে
সহযোগিতা প্রদান করছেন। শেখ রেহানা লন্ডনে অবস্থানকালে সন্তানদের মানুষ করার পাশাপাশি সেখানে বসবাসকারী বাঙালি কমিনিউটির সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত থেকে
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে যুক্ত থেকেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তিনি এই দাবি নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর তিনি বোনের পাশে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন এবং তাকে নীরবে নিভৃতে থেকে নানাভাবে সহযোগিতা
করেছিলেন। তিনি ঢাকা এবং লন্ডনে তার সন্তানদের পাশে থাকার পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত রাখতেন। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে
তিনি বোনের পাশে ছায়ার মতো অবস্থান করার চেষ্টা করছেন।
তিনি সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার যৌথ চেষ্টায় একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয় এবং এই ট্রাস্টিই
বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িটিকে ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ওই জাদুঘরের
উন্নয়নে শেখ রেহানাও যথাসাধ্য অবদান রাখার চেষ্টা করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কল্যাণে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন।
শেখ রেহানা বড় বোন শেখ হাসিনার পাশে থেকে তাকে শক্তি ও সাহস জোগাচ্ছেন। কিন্তু তিনি নিজে কখনও প্রকাশ্য রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছেন না। কারণ
তিনি মনে করেন যে, তার বড় বোন শেখ হাসিনা দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে পিতার মতোই সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে কাজ করছেন, তার পিতার আদর্শ
বাস্তবায়নে বড় বোনের ভূমিকাকে তিনি সবসময়ই বড় করে দেখছেন। বড় বোনও তাকে শুধু ছোট বোন নয়, সন্তানের ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখছেন।
৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বড় বোনের কাছ থেকে তিনি পিতামাতার ভূমিকাই পেয়েছেন সেকারণে বড় বোনই তার কাছে অনেক কিছু।
কোনো কোনো মহল দুই বোনের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ কাল্পনিকভাবে ছড়ানোর চেষ্টা করেছে অতীতে। এমনকি নানা দুর্নীতির কল্পকাহিনি ছড়িয়েও শেখ
রেহানাকে নানাভাবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এসবই প্রতিক্রিয়াশীলদের হীন, ঘৃণ্য ও নোংরা চেষ্টা। কিন্তু শেখ রেহানা সাধারণ মানুষের মতোই
জীবনযাপন করেন। তার চাহিদাও তেমন কিছু নেই- পিতার আদর্শ বাস্তবায়ন ও বোনের সাফল্য দেখা ছাড়া। শেখ রেহানার স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন
সাবেক অধ্যাপক। পারিবারিক ঐতিহ্যও তাদের সুবিদিত। নিজের সন্তানরাও মেধা-মনন, চিন্তাচেতনা এবং কর্মে অত্যন্ত যশ ও খ্যাতিসম্পন্ন।
তিনি মায়ের মতোই নীরবে-নিভৃতে জীবনযাপন করতে পছন্দ করেন। কিন্তু বোনের যেমন তিনি একজন ছায়াসঙ্গী, একইভাবে পুত্রকন্যাদেরও তিনি চমৎকার
অভিভাবক। তার ধ্যানজ্ঞানে পিতার আদর্শের বাংলাদেশ। তবে তিনি কখনই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু দুর্বৃত্ত জড়িত ছিল এই কথাটি
বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এ নিয়ে তার মনে বড় ধরনের ক্ষোভ সবসময় ছিল, এখনও আছে।
রাজনীতিতে তাই নিজেকে ততটা সক্রিয় দেখতে চান না। কিন্তু রাজনীতি যে তার রক্তের সঙ্গেই জড়িত। তবে সেই রাজনীতি হচ্ছে দেশপ্রেমের, মানবকল্যাণ এবং
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার। সেটিই তারও জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, সেকারণেই তিনি বোন ও সন্তানদের পেছনে থেকে সবাইকে সহযোগিতা প্রদান করে
যাচ্ছেন। এখানেই শেখ রেহানা নিজেকে একজন ব্যতিক্রমী মানুষের স্থান তৈরি করছেন।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ ও স্মৃতি পাঠাগার