দেশে নারী আসামীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দিনে এরূপ কয়েকটি মামলা দেখলাম যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর কোনো ভূমিকা নেই, অথচ মামলার আসামী হয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে পুরুষ অপরাধের সুবিধাভোগী বা নারী-পুরুষ দুজনেই এর সুবিধাভোগী; অথচ মামলার জালে আটকা পড়ছে শুধুই নারী। আর এই মামলাগুলো হচ্ছে চেক ডিসঅনারের অতি সাধারণ মামলা।
জমিলার কথা বলি। তার বাড়ী মঙ্গাপীড়িত কুড়িগ্রামের চর ভূরুংগামারী। স্বল্প শিক্ষিত পর্দানশীন জমিলা তার স্বামীর একান্ত অনুগত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি মামলার বাদীকে পাওনার টাকা পরিশোধের জন্য ০৫ লক্ষ টাকার চেক দিয়েছেন। সেই চেক তার একাউন্টে অপর্যাপ্ত তহবিলের কারণে ডিসঅনার হয়েছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত টাকা লোন নিয়েছিলেন কেন? জানালেন, তিনি এক টাকাও নেন নি। তার স্বামী ১ লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন ফাঁকা চেক দিয়ে। সেই টাকা নিয়ে তার স্বামী ঢাকায় পালিয়েছেন। বাদী সেই চেক দিয়ে ০৫ লক্ষ টাকার মামলা দিয়েছেন। ভিটে বাড়ীটা ছাড়া তার আর কোনো সম্পদ নেই। এই টাকা কোনোভাবেই তার পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব নয়। জমিলার স্বামী এক বছর আগে পালিয়েছে। উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ের উপর চাপিয়ে পালিয়েছে। নারীরা ঘর সন্তান ছেড়ে পালাতে পারে না । জমিলারা পালাতে পারে না বলে আমরা খুব সহজেই তাদের উপর বিনিয়োগ করি, ঋণ দেই।
এবার দুলালীর কথা বলি। তার বিরুদ্ধেও ৩০,০০০ টাকা চেক ডিসঅনারের অভিযোগ। একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। তবে তার ভাগ্য ভালো। জমিলার মত তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায় নি। প্রত্যেক তারিখে তার স্বামী তার সাথে আসে। তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ঋণের টাকা নিয়ে কি করেছিলেন? জানালেন, সংসারের কাজে লাগিয়েছেন টাকাটা। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, দেশে প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি ক্ষুদ্রঋণ পান নারীরা। এর মাধ্যমে কিছু সংখ্যক নারী সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন এবং নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে- সত্য। কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে নারীর পাওয়া ঋণের টাকা পুরুষরাই খরচ করে থাকেন।
জমিলা ও দুলালী দুজনেই জানিয়েছেন, তারা যদি জানতো চেক ডিসঅনার হলে মামলা হয়, মামলায় আসামীর অনধিক ১ বছরের জেল বা চেকে বর্ণিত টাকার ৩ গুণ পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড হয়, তাহলে তারা এই চেক দিত না। আবার, আসামীর সাজা হলে আইনের বিধান মোতাবেক চেকে বর্ণিত টাকার কমপক্ষে ৫০ শতাংশ টাকা চালান মূলে জমা না দিলে আসামীর আপীলের শর্তে জামিন বিবেচনার সুযোগ নেই। জমিলা ও দুলালীর চেকের পরিণতি জানা ছিল না। কিন্তু চেক ডিসঅনার হওয়ার পরিণতি সম্পর্কে অজ্ঞতা কোনও ওজর হতে পারে না। আইন কখনও এই সুবিধা দেয় না।
অনেকে জেনে শুনেই ফাঁকা চেক দেয়। বাধ্য হয়েই এভাবে ঋণ নেয়। আমাদের সমাজে কোনো কোনো নারীর বেতনের চেক দিয়ে একাধিক জায়গায় লোন নেওয়া হয়েছে। মাস শেষে শূণ্য হাতে বাড়ি ফেরে এমন নজীরও আছে। অনেকে এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে অন্য এনজিও এর দেনা শোধ করছে। শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর যেই ঋণ গ্রহণ করুক না কেন যে টাকা ঋণ গ্রহীতা নিজে ব্যবহার করতে পারেন নি বা সংসারের কাজের জন্য ব্যয় হয়েছে, সেই টাকার জন্য শুধুই নারীকে কেন মামলার ঘানি টানতে হবে?
ব্যক্তি পর্যায়ে স্বামী তার স্ত্রীকে ব্যবহার করে এরূপ ঋণ গ্রহণ হয়তো খুব কম। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর সংখ্যা অনেক বেশী। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, বর্তমানে দেশের তিন কোটি ৫২ লাখের বেশি পরিবার ক্ষুদ্রঋণ পরিষেবার আওতায় রয়েছে। ফলশ্রুতিতে আমরা এক নবীন গভীর ও বদলে যাওয়া সময়ের মুখোমুখি। তাই সময়ের প্রয়োজনে এই নীতিমালার কিছু পরিবর্তন জরুরী হয়ে পড়েছে।
নারী যাতে ঋণের টাকা নিজেই খরচ করে জীবন মানের পরিবর্তন করতে পারে এ বিষয়ে প্রত্যেকেটি সংস্থায় পৃথক মনিটরিং সেল থাকতে হবে। ঋণ দাতাকে ঋণ প্রদানের পূর্বে চেক ডিসঅনারের পরিণতি কী হবে তা নিশ্চিত করতে হবে। ঋণ গ্রহীতার পেশা, ঠিকানা, ঋণের ধরন, টাকার ব্যবহার এবং খেলাপি ঋণ ইত্যাদি বিষয়ে সরকারীভাবে একটি লোনের ডাটাবেজ করতে হবে। কিছু কিছু ক্ষুদ্র ঋণ পরীক্ষামূলকভাবে যৌথ হিসাবের বিপরীতে দেওয়া যেতে পারে।
২০১৭ সালের কারা জনসংখ্যা প্রতিবেদন অনুসারে সে সময় দেশের কারাগারগুলোতে মোট সাজাপ্রাপ্ত আসামীর মধ্যে চেক ডিসঅনারের কয়েদি ছিলেন ৪৭২ জন। এর মধ্যে নারী কয়েদি ছিলেন মাত্র ১৪ জন। কিন্তু এখন প্রায় প্রতিদিনই এমন মামলা পাই। হঠাৎ করে এই বেড়ে যাওয়াটা আশংকাজনক। এখনই এর লাগাম টেনে ধরার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে দেশে শীঘ্রই নারী কয়েদিদের সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়ে যাবে।
বিঃ দ্রঃ – মামলার ঘটনাগুলো সত্য। আসামীদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
লেখক- মোঃ সাইফুল ইসলাম, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, কুড়িগ্রাম।