মোঃ খলিলুর রহমান সাতক্ষীরা::
সুন্দরবন জাদুমাখা এক নাম। কাঁদামাটির ওপর বুকের পাঁজরের মতো শেকড় বেরিয়ে থাকা বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনে রয়েছে বিশাল সবুজের সমারোহ। ফুটে আছে বিচিত্রবর্ণের ফুল। তার ওপর উড়ছে-বসছে মৌমাছি, অরণ্যের ভয়ঙ্কর বাঘ, দাতাল শুকর, বিষধর সাপ। বঙ্গোপসাগর থেকে ছুটে আসা ভেজা লবণাক্ত বাতাস। প্রকৃতির সৌন্দর্য, অ্যাডভে ার, ভয় ও শিহরণের স্থান সুন্দরবন। পানিতে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ। এ যেন প্রকৃতির অকৃপণ সৃষ্টি। পর্যটকদের কাছে সুন্দরবনের আকর্ষণ তাই দুর্ণিবার। একঘেয়েমি কর্মময় জীবন থেকে ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে আসতে পারেন অনিন্দ্য সৌন্দর্যের লীলাভ‚মি সুন্দরবনে। বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম সুন্দরবন বনভূমি। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একটি উলেখযোগ্য কেন্দ্র হিসেবেও এটি বিবেচিত। এখান থেকে সংগৃহীত হয় নানা কাজে ব্যবহার উপযোগী বনবৃক্ষ, আহরিত হয় প্রচুর পরিমাণ মধু, মোম ও মাছ। সাতক্ষীরা, খুলনা এবং বাগেরহাট জেলার অংশবিশেষ জুড়ে সুন্দরবন বিস্তৃত। পরস্পর সংযুক্ত প্রায় ৪০০ নদী-নালা, খালসহ ২০০টি ছোট বড় দ্বীপ ছড়িয়ে আছে সুন্দরবনে। আজ থেকে ২০০ বছর পূর্বেও মূল সুন্দরবনের এলাকা ছিল ১৬,৭০০ বর্গ কিমি। বর্তমানে সংকুচিত হয়ে আয়তনের এক-তৃতীয়াংশে পৌঁছেছে।
এ বনের প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি সুন্দরী এবং গেওয়া। ৫০টি প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদপ্রজাতির মধ্যে কেবল সুন্দরবনেই আছে ৩৫টি প্রজাতি।
সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার লবণাক্ত পানির বনভূমিতে গেওয়া, গরান, কেওড়া, ওড়া, পশুর, ধুন্দুল, বাইন এবং সুন্দরী উদ্ভিদ প্রধান। প্রায় সব খালের পাড়েই ঘনভাবে জন্মে গোলপাতা। দ্বিতীয় উদ্ভিদ পর্যায়ে আছে গরান, গেওয়া, তুনশা, সুন্দরী, পশুর, এবং ঝানা। সুন্দরবনে নানা ধরনের প্রাণীর বাস।
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গুরুত্বপূর্ণ আবাস এখানেই। অধিকন্তু এ বনভূমিতে আছে প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি, প্রায় ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়া সুন্দরবনের উলেখযোগ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, রেসাস বানর, বন বিড়াল, লিওপার্ড, সজারু, উদ এবং বন্য শূকর। সমুদ্র এবং বড় বড় নদীর উপক‚লভাগে দেখা যায় বহু প্রজাতির গাংচিল, জলকবুতর, টার্ন ,চিল, ঈগল, শকুন সহ প্রায় ২২ প্রজাতির প্রতিনিধি এখানে রয়েছে। পাখি সম্পদে উৎকর্ষ সুন্দরবনে কাঠঠোকরা, ভগীরথ, পেঁচা, মধুপায়ী, বুলবুল, শালিক, ফিঙে, বাবুই, ঘুঘু, বেনে বৌ, হাঁড়িচাঁচা, ফুলঝুরি, মুনিয়া, টুনটুনি ও দোয়েলসহ রয়েছে নানা ধরনের ছোট ছোট গায়ক পাখি।
৫০ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সদস্য মোহনার কুমির গুইসাপসহ টিকটিকিজাতীয় সরীসৃপ, কচ্ছপ এবং সাপের প্রতিনিধিত্ব সন্তোষজনক। সাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজগোখরা, রাসেলস ভাইপার, অজগর, ব্যান্ডেড ক্রেইট এবং কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ। এ বন অ লের অন্যান্য উভচরের মধ্যে রয়েছে স্কিপার ফ্রগ, ক্রিকেট ফ্রগ, গেছো ব্যাঙ এবং সাধারণ কুনো ব্যাঙ।
সুন্দরবনের জলাশয়গুলিতে বাস করে প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতিগুলির মধ্যে তালিকাবদ্ধ হয়েছে প্রায় ২০ প্রজাতির চিংড়ি, ৮ প্রজাতির লবস্টার, ৭ প্রজাতির কাঁকড়া, কয়েক প্রজাতির শামুক এবং ৬ প্রজাতির ঝিনুক। চিংড়ির মধ্যে বাগদা চিংড়ি ও হরিণা চিংড়ি এবং কাঁকড়ার মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবনের অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি মৌমাছি। স্থানীয়ভাবে পরিচিত মৌয়ালদের পেশা মধু সংগ্রহ করা। তারা বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে ফুলের মৌসুমে তিন চার মাস বন থেকে মধু সংগ্রহ করে।
সুন্দরবন বা সুন্দরবনের সংলগ্ন এলাকাতে খুব কম মানুষজনই স্থায়ীভাবে বসবাস করে। স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে বাওয়ালি, মউয়াল এবং কাঠুরে। বনের ধার ঘেঁষে ৩-৫ মিটার উঁচুতে কাঠ বা বাঁশের ম তৈরি করে তার উপর তারা ঘর বাঁধে। বিশেষ করে বেদেরা নৌকায় যাযাবর জীবন কাটায়। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বহুলাংশে প্রাকৃতিক পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। সুন্দরী, গেওয়া এবং অন্যান্য বৃক্ষ প্রজাতি একত্রে যথাক্রমে প্রায় ২৪, ৫৪ এবং ২২ শতাংশ চারা উৎপন্ন করে।
ভ্রমণের জন্য পর্যটকদের এক আকর্ষণীয় স্থান সুন্দরবন। এখানকার কটকা, হিরণ পয়েন্ট (সাধারণভাবে নীলকমল নামে পরিচিত), দুবলার চর এবং টাইগার পয়েন্ট (কচিখালী)-এ প্রতিবছর পর্যটকদের প্রচুর সমাগম ঘটে। কটকার অনবদ্য প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং বন্যপ্রাণী ভ্রমণকারীদের জন্য অতি আকর্ষণীয়। এখানে বনবিভাগ পরিচালিত একটি ডাকবাংলো এবং একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার আছে। হিরণ পয়েন্টেও আছে পর্যটকদের জন্য অতিথি ভবন এবং একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। দুবলার চর একটি ছোট দ্বীপ, এর সমুদ্র সৈকত অতি মনোরম। এর অন্য আরেকটি আকর্ষণ মাছ ধরার কর্মকান্ড, যা প্রতিবছর মধ্য অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলে। এ সময় দেশের বিভিন্ন অ ল থেকে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকে আসে শত শত জেলে। এখানে তারা মাছ ধরে এবং রৌদ্রোজ্জ্বল বেলাভূমিতে তা শুকায়। মধু সংগ্রাহক মউয়ালরা সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বনের গভীরে ঢুকে মৌচাক খোঁজে।
সুন্দরবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব এর সংরক্ষণমূলক ভূমিকা। এ বন উপকূলভাগের ভূমিক্ষয় রোধ করে, উপকূলীয় এলাকা পুনরুদ্ধার করে এবং নদীবাহিত পলি স্তরীভূত করে। এর মোহনা অ ল বহু ধরনের মাছের প্রজনন কেন্দ্র। সুন্দরবনের বনসম্পদকে কেন্দ্র করে কয়েকটি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। উদ্ভিদনির্ভর শিল্প-কারখানার মধ্যে রয়েছে দিয়াশলাই ও নৌকা তৈরির কারখানা।এ বনভূমি জ্বালানি, ট্যানিন, ঘরের ছাউনি তৈরির উপকরণ, কাঠজাত দ্রব্য, ভেষজ উদ্ভিদ এবং পশুখাদ্যের অন্যতম প্রধান উৎস ও যোগানদার। দেশের অধিকাংশ মধু ও মোম সংগৃহীত হয় সুন্দরবন থেকেই।
প্রকাশক ও সম্পাদক- রবিউল ইসলাম। প্রধান কার্যালয়ঃ ২২ পশ্চিম-ধানমন্ডি, শংকর, ঢাকা-১২০৯। মোবাইল: ০১৭১৫-২০৯৬২৪। ফোন: +৮৮০২৯৫৫১৬৯৬৩ । ই-মেইল: alochitokantho@gmail.com । স্বত্ব © ২০২১ আলোচিত কন্ঠ
Copyright © 2024 আলোচিত কণ্ঠ. All rights reserved.