সাইফুর রহমান শামীম, কুড়িগ্রাম:
আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে রাত জাগা প্রহরীর মতো সেহেরির সময় মানুষকে জাগানোর কাজ করে যাচ্ছেন আবু হোসেন (৬৫)। রমজান এলেই সেহরি সময় আবু হোসেনের ভরাট গলার ডাকের অপেক্ষায় থাকেন তিন গ্রাম (কদমতলা, সিতাইঝাড় নয়ারহাট) এলাকার বাসিন্দারা। রাত ১.৩০ মিনিটে এক হাতে টর্চলাইট অন্য হাতে টিনের তৈরি হরেণে মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে করতে বেরিয়ে পড়েন তিনি।
ঘুমন্ত মানুষের উদ্দেশে আবু হোসেন বলতে থাকেন ‘জাগো... জাগো... জাগো আল্লাহর বান্দারা জাগো। সেহরি খাওয়ার সময় হয়েছে, ঘুমিয়ে থাকেন না আর। জাগো জাগো।’
সেহরি শুরু হওয়ার সময় থেকে শেষ সময় পর্যন্ত ক্ষণে ক্ষণে টিনের হর্নের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আবুর গলার ডাক। যার ডাক শুনে প্রতন্ত গ্রাম চরাঞ্চলের মানুষজন জেগে উঠেন, নেন সেহেরি খাওয়ার প্রস্তুতি।
জানা যায়, আবু হোসেন রোজাদার মানুষের ক্লান্তির ঘুম ভেঙে সঠিক সময়ে সেহেরি খাওয়ার ডাক দিয়ে আসছেন প্রায় ২৭ বছর ধরে। রোজা রাখার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেকেই ঘুমে বিভোর থাকায় সঠিক সময় জেগে উঠতে পারেন না। আবার ঘুম না ভাঙার কারণে শেষ পর্যন্ত রোজাটাই রাখতে পারেন না অনেকেই। বিশেষ করে প্রতন্ত গ্রাম ও চরাঞ্চলে পরিবারেরা এই রকম অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনায় পড়ে থাকেন। মাইকের ব্যবহার কিংবা মাইকে সেহেরির সময় ঘোষণাকারীর অভাবে সময় মতো জাগতে পারে না অনেকেই। এসব বিষয় চিন্তা করে পায়ে হেঁটে গভীর অন্ধকারে নদীর তীরে তীরে এলান দিয়ে মানুষকে জাগ্রত করে আসছেন আবু হোসেন। টানা ২৭ বছর ধরে মুখে হর্ন বাজিয়ে রোজাদারদের জাগিয়ে তোলা আবু হোসেনকে অনেকেই ‘হরেন আবু’ নামে চিনেন।
আবু হোসেন জানান, ১৯৯৫ সালে চিল্লায় যান তিনি। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আল্লাহ আর আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে নিরবছিন্নভাবে সমর্পণ করেছেন এই বৃদ্ধ। বয়সের ভারে শরীর নুয়ে পড়লেও রাতের অন্ধকারে পথচলাতে কোনো অসুবিধা হয় না বলে জানান তিনি।
এই বৃদ্ধ বলেন, আমাদের এই গ্রামগুলো নদী ভেঙে ছন্নছড়া হয়ে গেছে। ঘনবসতি না থাকায় রাতে একে অপরের যোগাযোগ করার উপায় নেই। এই কথা চিন্তা করে আমি রমজানের পুরো মাসটা রাত ১.৩০ থেকে ফজর নামাজের পূর্ব সময় পর্যন্ত রাস্তা, মাঠ, নদীর কিনারে কিনারে টিনের মাইক দিয়ে ঘুমন্ত মানুষকে জাগ্রত করার চেষ্টা করি। আগে দূর-দূরান্তর পর্যন্ত হর্ন বাজিয়ে যেতাম। এখন আর বেশি দূর যেতে পারি না। তারপরেও ৩-৪ কিলোমিটার পর্যন্ত রোজ এলান দিয়ে বেড়াই। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি মরণ পর্যন্ত যেন তার গোলাম হয়ে কাজ করে যেতে পারি।
সিতাই ঝাড় গ্রামের নজরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ছোটকাল থেকে দেখে আসছি রমজান মাস এলেই আবু চাচা লাইট আর টিনের হর্ন নিয়ে গ্রামে গ্রামে সেহেরি খাওয়ার ডাক দিয়ে যান। গ্রামে মানুষ আমরা তার ডাকের অপেক্ষা থাকি। তিনি সঠিক সময়ে ডাক দিয়ে যান। এতে আমাদের সেহেরির সঠিক সময় জানতে পারি।
নজরুল বলেন, এই বৃদ্ধ বয়সে মুখ দিয়ে টিনের তৈরি হর্ন বাজাতে তার কষ্ট হয়। একটি হ্যান্ড মাইকের ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হতো।
সিতাইঝাড় গ্রামের সাদ্দাম হোসেন বলেন, আবু হোসেন চাচার ডাকের অপেক্ষায় থাকি। আমি শুনেছি আবু হোসেন চাচার টিনের হর্নটির বয়স ২৫ বছর। হর্নটি মরিচা পড়েছে। তাই একটি নতুন হর্ন কেনার জন্য ৫০০ টাকা দিলাম। উনি এ বয়সেও এই মহৎ কাজটি করে আসছেন বলে আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ফজলুল করিম রহ. জামিয়া মাদরাসার শিক্ষক মুফতি আল্লামা ইকবাল হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, রোজা রাখা ফরজ। ইসলামে সেহেরি খাওয়ার নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা আছে। এ ক্ষেত্রে একটু বিচ্যুতির হলে কিংবা সেহেরি না খাওয়ার দরুণ অনেক সময় রোজাটা মাকরুহ বা নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা থাকে। সেক্ষেত্রে আবু হোসেন খুবই ভালো কাজটি করে আসছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক এ কাজের প্রতিদান দেবেন।
পাঁচগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল বাতেন সরকার ঢাকা মেইলকে বলেন, রমজান মাসে ঘুমন্ত মানুষকে জেগে তুলে সঠিক সময়ে সেহেরির খাওয়ার আহ্বান সত্যি প্রশংসার দাবিদার। আমি উনার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে একটি হ্যান্ডমাইকের ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখব।
প্রকাশক ও সম্পাদক- রবিউল ইসলাম। প্রধান কার্যালয়ঃ ২২ পশ্চিম-ধানমন্ডি, শংকর, ঢাকা-১২০৯। মোবাইল: ০১৭১৫-২০৯৬২৪। ফোন: +৮৮০২৯৫৫১৬৯৬৩ । ই-মেইল: alochitokantho@gmail.com । স্বত্ব © ২০২১ আলোচিত কন্ঠ
Copyright © 2025 আলোচিত কণ্ঠ. All rights reserved.