মোঃ মজিবর রহমান শেখ,
অভাবের কারণে বড় মেয়েকে পড়াতে পারেননি আফতাবর রহমান৷ তাই স্কুলের গণ্ডি না পেরুতেই বিয়ে দেন তাকে৷ সন্তানদের নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখেও কিছু করতে পারেননি তিনি৷ কোন উপায় ছিল না তার। কারণ সম্বল হিসেবে অল্প একটু জমি আর একটি ভ্যান৷ সাত সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের একমাত্র আয়ের ভরসা আফতাবরের ভ্যানটি । তবে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি তিনি। বড় মেয়েকে পড়াতে না পারলেও দৃঢ় সংকল্প করেন বাকী সন্তানগুলোকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার৷ নিজের সবকিছুর বিনিময়ে হলেও সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যয় নেন তিনি ৷
ঠাকুরগাঁও জেলার বালীয়াডাঙ্গী উপজেলার বড় পলাশবাড়ী ইউনিয়নের বেলসাড়া গ্রামের বাসিন্দা আফতাবর রহমান ৷ স্ত্রী, এক ছেলে, তিন মেয়ে আর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে সাত সদস্যদের সংসার তার। পৈতৃক ভিটেমাটি, একটি ভ্যান, আর অল্প একটু চাষাবাদের জমি ছাড়া কিছুই নেই তার । ভ্যান চালিয়ে যা রোজগার হত তা দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি খরচ করতো সন্তানের পড়াশোনায়। নিজের চাষাবাদ কৃত জমি বিক্রি করে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন তিনি। বর্তমানে ভ্যান আর ভিটেমাটি ছারা কিছুই অবশিষ্ঠ নেই। ভ্যান চালিয়ে উপার্জন করে সংসারের ভরণপোষণের পাশাপাশি সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন৷ ছেলে মুন্নাকে ভর্তি করিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর সম্প্রতি মেডিকেল কলেজ ভর্তি ফলাফল পরীক্ষায় দ্বিতীয় মেয়ে আলপনা আক্তার ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। আর ছোট মেয়ে এইচএসসিতে পড়াশোনা করছে । ভ্যান চালক আফতাবরের সন্তানদের এমন সফলতায় পরিবার সহ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন তারা ৷ এ নিয়ে এলাকাজুড়ে চলছে একটি আনন্দঘন পরিবেশ ৷ আলপনার সহপাঠি রুনা আক্তার বলেন, আলপনা আমার বান্ধবী ও প্রতিবেশী ৷ ছোটবেলা থেকেই একসাথে পথচলা আমাদের। একসাথে স্কুল আর কলেজ ৷ ক্লাশে অনেক মেধাবী ছিল সে। আমাদের বন্ধু বান্ধবীদের চেয়ে সে ছিল ব্যতিক্রম ৷ আর পড়াশোনায় ছিল অনেক মনযোগি। তার এই সফলতায় আমরা সকলে খুশি। আশা করছি সে মানবিক ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে পারবে। স্থানীয় প্রতিবেশী রুহুল কবির বলেন, এখন আমাদের ভাতিজি আমাদের গর্বের বিষয়। আমাদের এলাকায় অনেক দরিদ্র মানুষ বসবাস করেন। সে ডাক্তার হলে আমাদের এলাকার জন্য ভাল কিছু করতে পারবে এই প্রত্যাশা রইল৷ বালিয়াডাঙ্গী
উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মোঃ রাজিউর রহমান জেহাদ রাজু বলেন, আমাদের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় কৃতি সন্তানের তালিকায় আলপনার নাম যোগ হতে যাচ্ছে। আমরা আশা করছি সে একজন মানবিক ডাক্তার হবে৷ সে যেরকম পরিবার থেকে উঠে এসেছে আশা করছি সে বুঝবে। পরবর্তীতে সে সেইসমস্ত অসহায় ও দারিদ্র্য পরিবারের জন্য ভাল কিছু করতে পারবে৷
মেডিকেলে চান্সপ্রাপ্ত কলপনা আক্তার বলেন, আমার এই ক্ষুদ্র সফলতায় আমি মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। যে কথাটি না বললেই নয়। যার অনুপ্রেরণায় আমার এ সফলতা তিনি হলেন আমার বাবা। যিনি সারাদিন ভ্যান চালিয়ে রোজগার করেন পরিবার চালান৷ আর আমাকে স্বপ্ন দেখান ডাক্তার হওয়ার৷ আমাদের পরিবারটি অনেক কষ্ট করে চলে কিন্তু এটি আমার বাবা আমাকে এক সেকেন্ডের জন্যও বুঝতে দেইনি। আমরা বুঝতে পারলেও আব্বা কোনভাবে বুঝতে দিতেন না অভাবটা৷ বাবার পাশাপাশি আমার মা অনেক পরিশ্রম করেছেন। আমার কেমন ফলাফল হবে এটা আমার চেয়ে আমার মা আগেই বলে দিতে পারতেন। আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আমাকে অনেকভাবে সহযোগিতা করেছেন৷ আমি প্রথমে মানবিক শাখায় ভর্তি হয়েছিলাম৷ কিন্তু বিদ্যালয়ের স্যারেরা আমাকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য পরামর্শ দেন৷ পাশাপাশি অনুপ্রেরণা দেন যে, আমি পারব৷ সেখান থেকে আমার স্বপ্নটি আরও বেগবান হয়। আমার এই ফলাফলে আমার বাবা মা যে খুশি হয়েছে এটাই আমার বড় স্বার্থকতা। আর আমাদের মত পরিবারের ছেলে মেয়েরা স্বপ্ন দেখতে ভয় পাই। তবে আমি মনে করি দারিদ্র্যতা সফলতার অন্তরায় না৷ স্বপ্ন আর পরিশ্রম একসাথে করলে সফল হওয়া সম্ভব৷ আলপনার মা মাজেদা খাতুন বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে স্বপ্ন দেখেছিলাম মেয়েকে ডাক্তার বানাব৷ আজকে তার যাত্রা শুরু হল। আমার মেয়ে বলত- মেয়ে মানুষকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আমরা বলতাম তোমার মেধা আছে তুমি পড়াশোনা কর। যত কষ্টই হোক না কেন আমরা তোমার খরচ বহন করব। আজকে সে আমাদের আশা পূরুণ করেছে৷ আমাদের কোন অর্থ নেই তবে স্বপ্ন আছে। দেখা যাক আল্লাহ কী করেন৷
আলপনার বাবা আফতাবর রহমান বলেন, টাকার অভাবে বড় মেয়েকে পড়াতে পারিনি৷ পরে স্বপ্ন দেখেছি বাকী সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করব৷ একদিন আমি ভ্যান চালিয়ে রাতে বাসায় আসলাম৷ খাওয়ার সময় ছেলেটা বললো- বাবা দোয়া করিও আমি যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারি।
আলহামদুলিল্লাহ, সে এখন ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছে৷ সেভাবে আমার মেয়েকেও আমি কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছি৷ আমার মেয়ে বললো সে টাকা পয়সার ঘাটতি বুঝতে পারেনি৷ আমি সারাদিন ভ্যান চালিয়ে কষ্ট করতাম শুধুমাত্র তাদের জন্য। আমার ২৫ শতক আবাদী জমি ছিল। ছেলেকে ভর্তি করার জন্য ৫ শতক বিক্রি করতে হয়। পরে ছেলে ও মেয়েকে পড়াশোনা করানোর জন্য বাকী ২০ শতক জমিও বিক্রি করতে হয়৷ এখন ভ্যান আর ভিটেমাটি ছাড়া কিছুই নেই আমার৷ তারপরেও আজকে আমি অনেক খুশি। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ডাক্তারি পড়ানো অনেক খরচ। আমি চেষ্টা করব আমার সাধ্যমত। তবে যদি সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হয় তাহলে আমার কষ্টটা কম হবে৷ সরকারি সুযোগ সুবিধা আলপনা পাবে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে বালীয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যোবায়ের হোসেন বলেন, যদি আলপনার বাবা চান তাহলে তার পড়াশোনার খরচের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে উপজেলা প্রশাসন।
প্রকাশক ও সম্পাদক- রবিউল ইসলাম। প্রধান কার্যালয়ঃ ২২ পশ্চিম-ধানমন্ডি, শংকর, ঢাকা-১২০৯। মোবাইল: ০১৭১৫-২০৯৬২৪। ফোন: +৮৮০২৯৫৫১৬৯৬৩ । ই-মেইল: alochitokantho@gmail.com । স্বত্ব © ২০২১ আলোচিত কন্ঠ
Copyright © 2025 আলোচিত কণ্ঠ. All rights reserved.