দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করেছিল বিশ্বব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে থাকার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেও ব্যর্থ হওয়ায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করা হয়।
ফোন করানো হয়েছিল সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী শেরি ব্লেয়ারকে দিয়ে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিও দিয়েছিলেন চাপ। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট দুইবার সজীব ওয়াজেদ জয়কে ডেকে নিয়ে বলেছে, ‘তোমার মাকে বলো-এমডির পদ থেকে ইউনূসকে সরানো যাবে না’।
২০১২ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ দলের নেতারা সরকারের সমালোচনা করেন পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে। এসময় বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করে। পাশাপাশি জাইকা, এডিবিসহ দাতা-সংস্থাগুলোও সরে দাঁড়ায়। অথচ মন্ত্রীসহ কারও বিরুদ্ধেই কোনও অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। কানাডার এক আদালতে মামলা করা হলেও বিশ্বব্যাংক কোনও প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।
নানান ষড়যন্ত্র ও চাপ উপেক্ষা করে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে। তিনি এটাও বলেন, ‘কোনও দুর্নীতি করা হয়নি। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগের সামনে মাথা নত করবে না বাংলাদেশ’। বঙ্গবন্ধু-কন্যা কথা রেখেছেন।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকার করা হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ১৯৯৮-৯৯ সালে সেতুর প্রি-ফিজিবিলিটি সম্পন্ন করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর জন্য ডিজাইন কনসালট্যান্ট নিয়োগ করে। কনসালট্যান্ট সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রাথমিক ডিজাইন সম্পন্ন করে এবং সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহবান করে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। স্বপ্নের সেতুটি এখন দৃশ্যমান, উদ্বোধন হচ্ছে আগামী ২৫ জুন।
এরপরও থেমে নেই ষড়যন্ত্র। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনক্ষণ সামনে রেখে সংঘটিত কয়েকটি ঘটনা সরকারের নীতি-নির্ধারকদের চিন্তায় ফেলেছে। এগুলো কি নিছকই দুর্ঘটনা, নাকি নাশকতা? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও তথ্য মন্ত্রী হাসান মাহমুদ এই ঘটনাগুলোকে নাশকতা হিসেবেই দেখছেন। তারা বলেছেন, সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ড, সিলেটে ট্রেনে আগুনসহ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নাশকতা হতে পারে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে গোয়েন্দাদের কাছে কিছু খবর আছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করেও নাশকতার আশঙ্কা করেন তারা।
পদ্মা সেতু দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত সহজ হবে, সময়ও কমবে। সেতুর ওপরের অংশ দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে, রেল চলবে নিচের অংশে। সেতুর এক প্রান্ত মাওয়া আর অপর প্রান্ত শরিয়তপুরের জাজিরা। শরিয়তপুর এই প্রথম ঢাকার সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ পাচ্ছে। চলাচল সহজ করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে পদ্মা সেতু। সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতুর প্রাথমিক প্রভাব পড়বে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি খাতে আর দীর্ঘমেয়াদী সুফল আসলে ভারী শিল্পখাতে। মোংলা বন্দর সচল হয়েছে। কাজ শুরু হয়েছে পায়রা বন্দরে। বড় গতিশীলতা আসবে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে। খুলনা ও বাগেরহাটের মাছ, যশোরের সবজি ও ফুল, বরিশালের ধান ও পান পুরো দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির ভিত্তি। সেতুর কারণে সব ধরনের কৃষিপণ্য তাদের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বাজারে দ্রুত যেতে পারবে। শুধু ঢাকা নয়, বড় বড় জেলাশহরগুলোতেও তাদের পণ্য যাওয়ার সুযোগ পাবে।
পদ্মা সেতুর কারণে লাভবান হবে খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলা। দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওই অঞ্চলে বিনিয়োগ আরও বাড়িয়েছেন এই পদ্মা সেতুকে সামনে রেখেই।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা। স্বাধীন দেশে তাদের যেমন বিচার হচ্ছে, তেমনি পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। যারা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে, তাদের কিছুতেই ছাড় দেওয়া যাবে না।
প্রকাশক ও সম্পাদক- রবিউল ইসলাম। প্রধান কার্যালয়ঃ ২২ পশ্চিম-ধানমন্ডি, শংকর, ঢাকা-১২০৯। মোবাইল: ০১৭১৫-২০৯৬২৪। ফোন: +৮৮০২৯৫৫১৬৯৬৩ । ই-মেইল: alochitokantho@gmail.com । স্বত্ব © ২০২১ আলোচিত কন্ঠ
Copyright © 2024 আলোচিত কণ্ঠ. All rights reserved.