৫ই আগষ্ট ১৯৭১ : কুষ্টিয়া শহরের আশপাশ এলাকায় হামলার জন্য ভারতের কৃষ্ণনগর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার এ্যাকশন ক্যাম্প হতে কুষ্টিয়ার গেরিলা কমান্ডার নওশের আলীর নেতৃত্বে একটি দল গঠন করা হয়। এই দলটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের পূর্বে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় হাটখোলা ক্যাম্পে এক রাত এবং পরে মুজিবনগর উপজেলার আনন্দবাসে একটি খৃষ্টান বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করেন। এখানে পূর্বে অবস্থানরত কমান্ডার হাফিজুর রহমান জোয়ার্দার বিশেষ কাজে কৃষ্ণনগর মুক্তিযোদ্ধা একশন ক্যাম্পে চলে যায়।
কৃষ্ণনগর ক্যাম্পের এই দলের ও হাটখোলা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের এবং অাশ পাশ এলাকার ছোট বড় দিয়ে ৩টি মুক্তিযোদ্ধার দল এখানে ( ভারতীয় এলাকায় ) অবস্থান করছিল। হঠাৎ করে জনৈকা ব্যক্তি বাংলাদেশ এলাকা হতে এসে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে সংবাদ দেয় যে , রাজাকাররা তাদের এলাকায় এসে তাদের পাকা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে বলে জানাই এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ধান কাটা বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করে। মুক্তিযোদ্ধারা জনৈকা ব্যক্তির কথায় বিশ্বাস করে। মুক্তিযোদ্ধারা নদী পাড় হয়ে ৫ই আগষ্ট ১৯৭১ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দামুরহুদার নাটুদা ও মুজিব নগরের মজেমপুর এর কাছে পাকিস্তানি সৈন্যের উপর হামলার জন্য প্রবেশ করেন। গেরিলা কমান্ডার নওশের আলী কভারিং পাটি নিয়ে পিছনে রয়ে যায়। কুষ্টিয়া কালী শংকরপুরের মোঃ মাহাফুজুল করিম (খোকন মাষ্টার) ও আলমডাঙ্গা থানার গোকুলখালীর হাসানুজ্জামান হাসান এর নেতৃত্বে অন্য একটি দল সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ানের কাছে পশ্চিম পাশে মাঠের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সামনের দলটি অাগের থেকে ওতঁপেতে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যের এ্যামবুশে পড়ে যায়। পাকিস্তানি সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তুমুল গুলাগুলি শুরু হয়। হাসানুজ্জামান হাসান ও খালেদ সাইফুদ্দিন আহম্মদ তারেক লাইট মেশিন গানের কভারিং ফায়ার দিয়ে দলের অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। হাসানুজ্জামান হাসান ও খালেদ সাইফুদ্দিন আহম্মদ তারেক সহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এই দলের পিছনে থাকা কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যান। কমান্ডার নওশের আলীর কভারিং পাটি এই যুদ্ধে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি সৈন্যের মধ্যে মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ানে রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এই যুদ্ধে যে সব মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তারা হলেন (১) হাসানুজ্জামান হাসান, পিতা- মো: ইয়াকুব হোসেন, গ্রাম- গোকুলখালী, থানা- আলমডাঙ্গা, জেলা- চুয়াডাঙ্গা, (২) খালেদ সাইফুদ্দিন আহম্মদ তারেক, পিতা- মহিউদ্দিন আহম্মদ, গ্রাম- কাটদাহ, থানা- মিরপুর, জেলা- কুষ্টিয়া, (৩) মো: আবুল কাশেম, পিতা- বজলুর রহমান, গ্রাম- চুয়াডাঙ্গা মাঝের পাড়া, থানা- সদর, জেলা- চুয়াডাঙ্গা, (৪) আলাউল ইসলাম খোকন, পিতা- মহিউদ্দিন আহম্মদ, গ্রাম- চুয়াডাঙ্গা বাজার পাড়া, থানা- সদর, জেলা- চুয়াডাঙ্গা, (৫) রবিউল ইসলাম, পিতা- মো: সিদ্দিক আহম্মদ, গ্রাম- মোমিনপুর, থানা- সদর, জেলা- চুয়াডাঙ্গা, (৬) কিয়ামুদ্দিন মন্ডল, পিতা- রহিম মন্ডল, গ্রাম- রোয়াকুলি, থানা- আলমডাঙ্গা, জেলা- চুয়াডাঙ্গা, (৭) রওশন আলম, পিতা- আজিজুর রহমান, গ্রাম- বটিয়াপাড়া, থানা- আলমডাঙ্গা, জেলা- চুয়াডাঙ্গা, (৮) মোঃ আফাজ উদ্দিন, পিতা- রমজান আলী, গ্রাম- কোমরপুর, থানা- মুজিবনগর, জেলা- মেহেরপুর। দেশ স্বাধীনের পর খালেদ সাইফুদ্দিন আহমেদ তারেক সাহসিকতার জন্য বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন।
এই যুদ্ধে যেসব মুক্তিযোদ্ধা কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যান তারা হলেন (১) মোঃ মাহাফুজুল করিম (খোকন মাষ্টার, কালী শংকরপুর, কুষ্টিয়া। (২) আলী আজগর ফটিক, রেলপাড়া, চুয়াডাঙ্গা, (৩) গোলাম মোস্তফা খান মোস্ত, জেন তলা পাড়া, চুয়াডাঙ্গা, (৪) হুমায়ুন কবির, কবিখালী, চুয়াডাঙ্গা, (৫) আজম আক্তার জোয়ার্দার পিন্টু, পৌরসভা পাড়া, চুয়াডাঙ্গা, (৬) নূরুল আমিন, জেন তলাপাড়া, চুয়াডাঙ্গা, (৭) নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম। (৮) আক্তারুজ্জামান (আক্তার) বঠিয়া পাড়া।
কভারিং পাটির মুক্তিযোদ্ধারা হলেন (১) কমান্ডার নওশের অালী, কুষ্টিয়া, (২) কমান্ডার ( পরবর্তী চুয়াডাঙ্গা থানা গেরিলা কমান্ডার ) বারেক শিকদার, ডামুড্যা, শরীয়তপুর, (৩) আব্দুল জলিল, কুষ্টিয়া, (৪) রফিকুল ইসলাম (টুকু),কালি শংকরপুর, কুষ্টিয়া,(৫) বাহা উদ্দিন, মজমপুর, কুষ্টিয়া, (৬) সুজা উদ্দিন, থানা পাড়া, কুষ্টিয়া, (৭) অানসার কমান্ডার, মেহেরপুর, (৮) হোসেন অালী, সিলেট অারো বেশ কয়েকজন।
মুজিবনগরের বাগোয়ানে শহীদ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে অধিকাংশই কৃষ্ণনগর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের এবং কুষ্টিয়া জেলার প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধার কাছে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তাদের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর কৃষ্ণনগর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ও কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। এই ঘটনা পর্যালোচনার জন্য কুষ্টিয়া জেলার কয়েক জন নাম করা গেরিলা কমান্ডার কৃষ্ণনগর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে একত্রিত হন। এই দলের কমান্ডার নওশের আলীকে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হয়। কৃষ্ণনগর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার কর্ণেল আর কে সিং ক্ষিপ্ত হয়ে কমান্ডার নওশের আলীকে কঠোর শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আলমডাঙ্গা ষ্টেশন পাড়ার গেরিলা কমান্ডার মো: আব্দুল হান্নান, আলমডাঙ্গা ষ্টেশন পাড়ার মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক ফরাদ ও কুষ্টিয়া হরিপুরের গেরিলা কমান্ডার সামসুল হাদীর অনুরোধে কর্ণেল আর কে সিং নওশের আলীকে ক্ষমা করেন এবং তাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অপারেশনে পাঠানো বন্ধ করে দেন।
লেখকঃ আব্দুল হান্নান
যুদ্ধকালীন গেরিলা কমান্ডার
আলমডাঙ্গা।।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি-খন্দকার গোলাম মওলা নকশেবন্দী। সম্পাদক/প্রকাশক-রবিউল ইসলাম। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক-সাবিহা প্রমানিক। প্রধান কার্যালয়ঃ ২২ ধানমন্ডি শংকর ঢাকা-১২০৯, মোবাইল: ০১৭১৫-২০৯৬২৪, ফোন: +৮৮০২৯৫৫১৬৯৬৩, ই-মেইল: alochitokantho@gmail.com ।