স্বপন কুমার রায়,খুলনা ব্যুরো প্রধানঃসেদিন মুহুর্মুহু গ্রেনেড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। আর্তনাদ আর প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি। রক্তে ভেজা রাজপথ, ছিন্নভিন্ন দেহ। শত শত জুতা-স্যান্ডেল পড়ে ছিল রাস্তায়। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে কাতরানি, সাহায্যের জন্য আহাজারি। গোটা জাতি বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সেই ভয়াবহতায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। আঠারো বছর পেরিয়ে গেলেও সেই বিভীষিকা আজও মানুষ ভুলতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন। স্প্লিন্টারের আঘাতে তিন শতাধিক আহত হন। এ ঘটনায় মামলার রায়ে আদালত জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সহায়তায় ওই হামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মহান আল্লাহর অশেষ রহমত ও জনগণের দোয়ায় আমি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায়। আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে আমাকে রক্ষা করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট যখনই সরকারে এসেছে, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়ে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা করেছে।
সেদিন যা ঘটেছিল :সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা, গোপালগঞ্জে তুষার হত্যাকাণ্ড এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মী হত্যা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ও গণমিছিল ডেকেছিল আওয়ামী লীগ।
২০০৪ সালের সেই ভয়াল দিন বিকাল ৩টা থেকে দলের মধ্যমসারির নেতারা বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। ৪টার দিকে জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তৃতার পালা। সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা আসেন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে। নেতাকর্মীরা অধীর আগ্রহে নেত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন। যে ট্রাকে সমাবেশের মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, তার পেছনে বাঁ দিকে একটি সিঁড়ি ছিল ওপরে ওঠার। ট্রাকের শেষ মাথায় ডানদিকে রাখা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন নেতারা। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুরু হয় বিকাল ৫টা ২ মিনিটে। তার দুই পাশে ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।
পুরোটা সময় ওই টেবিলের পাশে বসেছিলেন শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার আব্দুল্লাহ আল-মামুন। মঞ্চ থেকে নামার সিঁড়ির কয়েক গজের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতির বুলেট প্রুফ মার্সিডিজ গাড়ি। সেখানে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিক। ৫টা ২২ মিনিটে বক্তব্য শেষ করে শেখ হাসিনা মাইক থেকে সরে যাওয়ার মুহূর্তেই প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়া হয়। ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে সেটি বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে থাকা জ্যেষ্ঠ নেতা এবং নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ট্রাকের ওপর বসিয়ে দেন।
এর পরপরই বিস্ফোরিত হয় আরও তিনটি গ্রেনেড। চারদিকে ধোঁয়ায় আছন্ন হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত মেজর শোয়েব মো. তারিকুল্লাহ ট্রাকের সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে নামিয়ে আনতে বলেন।
মায়াসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে নামিয়ে নেয়ার সময় আরেকটি গ্রেনেড ট্রাকের পেছনের ডালায় বাড়ি খেয়ে পাশেই বিস্ফোরিত হয়। ফলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে আবার ট্রাকের ওপর বসে পড়তে বাধ্য হন সবাই।নেতাকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা সেখানে শেখ হাসিনাকে ঘিরে তৈরি করেন মানববর্ম। কিন্তু শোয়েব নিচ থেকে জানান, বিস্ফোরণে ট্রাকের তেলের ট্যাংক ফুটো হয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে ট্রাকে আগুন ধরে যেতে পারে।
শেখ হাসিনার পায়ের স্যান্ডেল তখন কোথায় ছিটকে গেছে, চশমাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। ওই অবস্থায় মামুন, শোয়েব এবং অন্যরা মিলে তাকে নিয়ে গাড়ির সামনে বাঁ দিকের আসনে বসিয়ে দেন। সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, বিস্ফোরণে আহত নেতাকর্মীদের ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না শেখ হাসিনা। অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে সুধাসদনে নিয়ে যাওয়া হয়।
শেখ হাসিনা যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন, তখনও গ্রেনেড ফাটানো হচ্ছিল। কানে আসছিল গুলির শব্দ। ওই হামলা আর বিস্ফোরণের পর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন নেতাকর্মীরা। ওই অবস্থায় রিকশা, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশাভ্যানে করেও আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করেন তারা।
ঝরে যায় ২৪ প্রাণ :সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। হামলায় গুরুতর আহত হন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫৮ ঘণ্টা পর (২৪ আগস্ট) মারা যান। হামলার প্রায় দেড় বছর পর মারা যান ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। সব মিলিয়ে পরে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ জনে।
২১ আগস্ট হামলায় নিহত অন্যরা হলেন- শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
আহতদের অনেকের জীবন পরবর্তীতে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সে সময় শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও তখন তিনি যে কানে আঘাত পান, সেই বোঝা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন। বাংলাদেশের মাটিতে যত ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে এটি অন্যতম।
হামলার উদ্দেশ্য :শেখ হাসিনা যেন বাঁচতে না পারেন, তার সব চেষ্টাই সেদিন করেছিল হামলাকারীরা। রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূল করতে রাষ্ট্রীয় মদদে এই সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল।
অভিযোগপত্র, বাদীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ, হরকাতুল জিহাদের (হুজি) প্রধান মুফতি হান্নান ও খালেদা জিয়ার ভাগনে সাইফুল ইসলাম ডিউক যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তাতেই এটি পরিষ্কার হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন
প্রকাশক ও সম্পাদক- রবিউল ইসলাম। প্রধান কার্যালয়ঃ ২২ পশ্চিম-ধানমন্ডি, শংকর, ঢাকা-১২০৯। মোবাইল: ০১৭১৫-২০৯৬২৪। ফোন: +৮৮০২৯৫৫১৬৯৬৩ । ই-মেইল: alochitokantho@gmail.com । স্বত্ব © ২০২১ আলোচিত কন্ঠ
Copyright © 2024 আলোচিত কণ্ঠ. All rights reserved.