মোঃ খলিলুর রহমান,সাতক্ষীরাঃ সমাজ ও পরিবারের নানা বাঁধা কাটিয়ে জীবন সংগ্রামে সাফল্য অর্জন করেছেন সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ৫ নারী। নানা বাঁধা বিপত্তিকে পায়ে মাড়িয়ে তৃণমূল থেকে উঠে আসা এসব নারীদের খুঁজে বের করে জয়ীতা অন্বেষনে বাংলাদেশ শীর্ষক কর্মসূচীর আওতায় ৫টি ক্যাটাগরীতে সম্মাননা দিয়েছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। বিশ^ নারী দিবসে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে তাদেরকে অনুকরণীয় করে রাখতে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। এ সকল নারীদের প্রত্যেকের জীবনে রয়েছে অসীম আত্মশক্তি ও সংগ্রামের আলাদা আলাদা জীবন কাহিনী। তাদের সেই সংগ্রামী জীবনের কিছু তথ্য পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী ফরিদা পারভীন:
জীবন সংগ্রামে দারিদ্রতাকে পিছনে ফেলে সাফল্য অর্জন করেছেন ফরিদা পারভীন। তিনি তালা উপজেলার ধানদিয়া কৃষ্ণনগর গ্রামের আব্দুল জব্বারের স্ত্রী। ১৯৮৮ সালের ৫ আগষ্ট তার বিয়ে হয়। সে সময় স্বামীর কোন আয় ছিল না এবং শারিরীক পরিশ্রমও করতে পারতেন না। বিয়ের পরে কোলজুড়ে আসে দুটি সন্তান। সন্তান ও সংসার নিয়ে দারুন বিপাকে পড়তে হয় তার। প্রাথমিকভাবে বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করা শুরু করেন তিনি। এতে টাকা উপার্জন হলেও সংসারের অভাব ঘুচেনি। এক পর্যায়ে তিনি হাঁস-মুরগির পাশাপাশি বাড়ির পাশে জমিতে বিভিন্ন শাক-সবজি চাষাবাদ করেন। টানা তিন বছর পর উপার্জনকৃত টাকা দিয়ে তিনি বাড়ির পাশে ছোট একটি দোকান নির্মাণ করে সেখানে একটি হার্ডওয়ারের মালামাল বিক্রি করতে শুরু করেন। বর্তমানে দোকানটি বেশ বড় হয়েছে। বাড়ির পুকুরে মাছের চাষও করা হয়। বাড়িতে ভাঙ্গাচোরা ঘরের স্থলে এখন পাকাবাড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি। সকল কাজে তাকে স্বামী ও সন্তানা সহযোগিতা করে। তার পুত্র আলমগীর হোসেন এবার এইচএসসি এবং কন্যা আম্বিয়া খাতুন এসএসসি পাস করেছে। দোকান থেকে বছরে প্রায় ২ লাখ টাকা আয় করেন তিনি। বর্তমানে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করছেন অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী ফরিদা পারভীন।
শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সফল নারী কল্যাণী দে:
শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী কল্যাণী দে। একজন শিশুকন্যা থেকে সফল নারী হয়ে ওঠা কল্যাণী দে তালা উপজেলার খলিষখালী গ্রামের সুনীল কুমার দে’র স্ত্রী। তিনি যশোরের কেশবপুর উপজেলা সদরের প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নিত্যানন্দ দে এবং মাতা গীতা দে’র কন্যা। ১৯৮৬ সালে তিনি বি,কম পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে খুলনা আযম খান কর্মাস কলেজে পড়াকালীন তার বিয়ে হয়। তখন তার স্বামী একটি বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ১৯৮৮ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি তালা উপজেলার খলিষখালী শৈব বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে বাণিজ্য বিভাগে যোগদান করেন। এরপর একই বিদ্যালয়ে তিনি ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
এছাড়া স্বামী, শাশুড়িসহ সকলের অনুপ্রেরণায় তিনি ২০০০ সালে ‘ভগ্নি নিবেদিতা’ নামের একটি বে-সরকারী সংস্থা নিবন্ধন করেন। যেখানে গরীব ও তালাকপ্রাপ্ত নারীদের তিনি নিজ খরচে আইনী সহায়তা প্রদান করতেন। তার একমাত্র কন্যা এমবিবিএস পাস। ২০১৩ সালে মেয়ের বিয়ে হয় এক বিসিএস ক্যাডার চিকিৎসকরে সাথে। এ সময় সমাজের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী সমাজকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
সফল জননী মনোয়ারা বেগম:
সফল জননী নারী হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত রোকেয়া বেগম সেলিনা । তিনি খলিলনগর ইউনিয়নের নলতা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃতঃ শেখ কওছার আলীর স্ত্রী। ছোট বেলায় পড়ালেখার প্রতি তার খুবই আগ্রহ ছিল। কিন্তু পিতা না থাকায় সে আসা পূরণ হয়নি তার। ১৯৬৯ সালে তার বিয়ে হয়। ১৯৭০ সালে তার গর্ভে শহিদুল ইসলাম নামের একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করলেও মাত্র ২০ দিন বয়সে বিনা চিকিৎসা সে মারা যায়। পরবর্তীতে একে এক ৬টি পুত্র সন্তান হয় তাদের। ০৯/০৯/২০০৮ সালে স্বামীর মৃত্যু হয়। স্বামী ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বামীর অবর্তমানে ছেলেদের তিনি অনেক কষ্ট করে তাদেরকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। ছেলেরা সকলেই শিক্ষিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত। ৬টি সন্তানই বর্তমানে সরকারী চাকুরীজীবী।
নির্যাতিতা থেকে উদ্যোমী, কর্মঠ ও স্বাবলম্বী নারী হেনা বেগম:
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নব উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী হেনা বেগম। তিনি তালা উপজেলার উপজেলার কানাইদিয়া গ্রামের শেখ মাহবুর হোসেনের কন্যা। স্বামীর পছন্দে এবং শ^শুর-শাশুড়ির অমতে বিয়ে হয় হেনা বেগমের। বিয়ের পর থেকে শ^শুর-শাশুড়ির নির্যাতনের শিকার হন তিনি। বিয়ের ২ বছর তাদের সংসারে একটা পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু স্বামীর কোন আয় রোজগার না থাকায় কষ্টে চলতো সংসার। সংসারের খরচ বাবার বাড়ি থেকেই মেটাতে হতো তাকে। এভাবে কেটে যায় সংসার। ৪/৫ বছর পর তিনি আরও একটা পুত্র সন্তান জন্ম হয়। ধীরে ধীরে তার উপর অত্যাচার বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে স্বামী, শ^শুর-শাশুড়ি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে বাবার বাড়িতে থাকতো সে। এ সময় শিশুপুত্রকে তারা কেড়ে নেয়। ছেলেরা মাঝে মাঝে গোপানে দেখা করে হেনা বেগমের সাথে। হঠাৎ একদিন স্বামী তাকে তালাকের কাগজ পাঠায়। কিন্তু সে সংসার করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে হেনা বেগম নতুন করে পড়ালেখা শুরু করে কিন্তু এসএসসি পাস করতে ব্যর্থ হন। পরে তিনি দর্জি বিজ্ঞান কলেজে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে একটি বেসরকারী সংস্থায় প্রশিক্ষক হিসেবে চাকুরী করতেন। ধীরে ধীরে তিনি বিভিন্ন ধরণের সামাজিক কাজের সাথে সম্পৃক্ত হন। এলাকাবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণে তিনি ২০২১ সালে তালার জালালপুর ইউনিয়নের ১,২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়ী হন। বর্তমানে সংরক্ষিত ইউপি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাকি জীবন জনগণের সেবার লক্ষ্যেই তিনি কাজ করে যাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন ফিরোজা বেগম:
একজন নারী হয়েও জীবন সংগ্রামের মাঝে সমাজের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন ফিরোজা বেগম। তিনি উপজেলার পাঁচপাড়া গ্রামের আব্দুর রউফ গাজীর স্ত্রী। তিনি ছিলেন খুব ডানপিঠে।