রনি মিয়া,স্টাফ রিপোর্টারঃ ‘হাওর-বাঁওড় পাহাড় নদী/ মরমিয়া গান-দরদী/ সুনামগঞ্জের সুনাম যে তাই সব জাগাতে ভাই/মন জুড়ানো এই জেলার তুলনা যে নাই…।’
গানে-সুরে দেশের উত্তর-পূর্ব কোণের সীমান্ত জেলা সুনামগঞ্জের এমনি সুনাম করেন কোনো এক বাউলশিল্পী। জল-জোছনার এই জনপদ ইতিহাস, ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ।
মরমি সাধক হাসন রাজা, বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমসহ অগুনতি সাধক-কবির জন্ম ধন্য এই জেলা। হাওরের জল-ঢেউ আর বসন্ত বাতাসে এখানে গানের সুর ভাসে।
প্রাণ-প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, সম্পদ-সম্ভাবনার এই জেলাকে এখন একনজরে জানতে ও বুঝতে একটি টিনশেড ভবনে গেলেই চলবে। দেড় শ বছরের পুরোনো ভবন, বেশ উঁচু। ভিন্নতা আছে দৈর্ঘ্য, প্রস্থেও। কক্ষগুলো বড়সড়।
কাঠের পাটাতনের মেঝে। নিচটা ফাঁকা। সামনে খোলা প্রান্তর। বলা হয় ‘আসাম প্যাটার্ন’র ভবন। নির্মাণশৈলী দারুণ। এখন এই দৃষ্টিনন্দন ভবন জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের ঠিকানা ‘সুনামগঞ্জ ঐতিহ্য জাদুঘর’।
সুনামগঞ্জ ঐতিহ্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে রক্ষিত বীর প্রতীকদের ডকুমেন্টারি, এ জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের ডায়েরি, ভিডিওসহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগ্রহ আমাদের আগামী প্রজন্মকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার সুযোগ করে দেবে বলে আমি মনে করি।’ মন্তব্যটি বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের।
২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল জাদুঘরটি পরিদর্শন করে পরিদর্শন বইয়ে এই মন্তব্য করেন তিনি। ‘জেলা পর্যায়ে এ জাতীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’ মন্তব্যে আরও যোগ করেন তিনি।
জাদুঘরের সদর দরজা পেরোলে ডানে পরিদর্শন বই রাখা। পাশেই জেলার প্রথম মহকুমা প্রশাসকের ব্যবহৃত চেয়ার-টেবিল, শতবর্ষ পুরোনো রাজকীয় টাইপরাইটার মেশিনসহ নানা দুর্লভ সামগ্রী রাখা। এরপর একে একে পাঁচটি কক্ষে জেলার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিষয়, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি; পরিবেশ ও প্রকৃতি, জীবন ও জীবিকা এই পাঁচ ভাগে গড়ে তোলা হয়েছে সংরক্ষণ ও সংগ্রহ।
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে মুগ্ধ করার বিষয় হলো জেলার ১ হাজার ৬৯১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নিজের হাতে লেখা ডায়েরি। এসব ডায়েরিতে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার ছবি, হাতের পাঁচ আঙুলের ছাপ, যুদ্ধে যাওয়ার বর্ণনা ও যুদ্ধ দিনের স্মৃতিকথা রয়েছে।
জাদুঘরে রাখা জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা স্মারকছবি: প্রথম আলো
এসব বীরযোদ্ধার অনেকেই আজ এ ধরায় নেই। মুক্তিযুদ্ধকালীন সুনামগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের পরিচিতি, জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে এখানে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি পর্ব এখানে সাজিয়ে রাখা।
আছে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি, জাতীয় চার নেতা, সাত বীরশ্রেষ্ঠ, ভাষাশহীদদের জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাস। সংস্কৃতি বিভাগে জেলার মরমি সাধকদের আলোকচিত্র, তাঁদের গানের পাণ্ডুলিপি, ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানা সামগ্রী।
সুনামগঞ্জের রূপ-সৌন্দর্যের বেশ কিছু আলোকচিত্র ও মানুষের ব্যবহৃত পুরোনো তৈজস দেখা গেল প্রকৃতি ও পরিবেশ বিভাগে। জীবন-জীবিকা বিভাগে হাওরে মাছ ধরা ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত বাহারি যন্ত্র সংরক্ষণ করা। এসব এখন হাওর এলাকা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে হাওরের মিঠা পানির ৩৬ প্রজাতির মাছ ছোট-বড় বয়ামে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের আলফাত স্কয়ার থেকে পূর্ব দিকে ডিএস রোড ধরে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে ডানে এই জাদুঘর। বাঁয়ে শহরের ঐতিহ্যবাহী সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়, শাপলা চত্বর।
দক্ষিণে জেলা স্টেডিয়াম, পূর্বে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ও কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। জাদুঘর যে ঘরে, সেটি একসময় জেলা ‘কালেক্টরেট’ ভবন ছিল। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় শহরের অন্যত্র স্থানান্তর হলে একসময় ভবনটি অযত্ন-অবহেলায় ‘পরিত্যক্ত’ হয়ে পড়ে।
এখানে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেন এ জেলার বাসিন্দা কবি ও গবেষক, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক। তিনি ২০১৪ সালের শেষ দিকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরীকে এটিতে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ধারণা পত্রসহ একটি চিঠি দেন। এরপর ভবন সংস্কারের কাজ শুরু হয়। আনুষ্ঠানিক জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি।
মোহাম্মদ সাদিক মনে করেন, এখন এটি জাতীয় জাদুঘরের শাখা হিসেবে যুক্ত হওয়া দরকার। তা হলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও সহযোগিতায় জাদুঘরটি আরও সমৃদ্ধ হবে।
সংগ্রহ বাড়ানো, সৌন্দর্যবর্ধন ও সংস্কারে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে—এমনটাই জানালেন জাদুঘর পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি ও জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী। তাঁদের আমন্ত্রণে ঢাকার কয়েকজন স্থপতি সম্প্রতি এটি দেখে গেছেন। এখানে শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা, সুভ্যেনির শপ হবে। ভবনটির যেহেতু নিজস্ব একটা ঐতিহ্য আছে, তাই এটির আদল পরিবর্তন করা হবে না।
‘হাওরকন্যা সুনামগঞ্জের মাছ, ধান আর গান; সুরমা তীরে এনেছে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ’, এই হচ্ছে জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের স্লোগান। শুধু ধান, মাছ আর গান নয়, পুরো সুনামগঞ্জই আছে এই জাদুঘরে। একবার গেলে এমনটাই মনে হবে যে-কারও।