💥কিছু প্রশ্ন:
সময় হয়েছে সকল রাজনৈতিক দল গুলোর আত্ম-সমালোচনা করার। আওয়ামীলীগ সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার, আর্থিক খাতে কিছু নেতা ও আমলার সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি জনমনে অস্বাভাবিক ভাবে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিলো। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় তারা আত্ম-অহমিকাবোধে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সাধারণ জনগণ তো বটেই দলীয় নেতা কর্মীরাও তাদের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করে, বলা যায় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোয় স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে বিভাজনের জন্ম দিয়ে একটা বিভাজিত জাতিরাষ্ট্র কায়েম করেছিলো। এত অন্যায় করেও তারা কি ভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল? অপরদিকে এতো বড় বড় বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলো আন্দোলনের পর আন্দোলন করে কেন ব্যর্থ হয়েছিল? জেল জুলুম হুলিয়া মাথায় নিয়েও জনগণের কাছে তাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হয়নি কেন? কেন তাদের আর্তচিৎকার জনগণের কর্ণকুহরে পৌঁছালেও তাদের নেতৃত্বে জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নামেনি? কেন ছাত্রজনতার নেতৃত্বে পিছনের কাতারে দাঁড়িয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করতে হয়েছে? অভ্যুত্থান উত্তর কেন তাদের নিজেদের বলে বেড়াতে হচ্ছে তারাও এই অভ্যুত্থানের অংশীদার ছিলেন? তাদের ভূমিকা নিয়ে কেউ তাদের ক্রেডিট না দেয়ায় তারা কেন অভিমান করছেন?
এসব প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই রয়েছে তাদের নিজেদের দলীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শিক সংস্কারের যৌক্তিকতা।
💥পতনের কারণ:
ক্ষমতা এবং অর্থ এমন একটি জিনিস যা সবাই ধারন ও সহ্য করতে পারে না। ক্ষমতা ও অর্থের গরমে মানুষ অন্ধ হয়ে যায় এবং সব কিছুকেই তুচ্ছজ্ঞান করে। ক্ষমতা আরোহণের পর ১৪, ১৯ ও ২৪ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার যে ভাবে জাতীয় নির্বাচন করতে সমর্থ হয়েছে তা ইতিহাসে বিরল। যদিও তার দ্বায় বিরোধীদের উপরও বর্তায়। কেননা জনগণের পালস না বুঝে এবং সামাজিক ইস্যু সামনে না এনে তারা শুধুমাত্র তাদের রাজনৈতিক ইস্যু সামনে আনায় জনগণ তা গ্রহণ করেনি। ফলে নির্বাচন উত্তর সরকার প্রশাসন ও সংসদে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হয়। এর ফলে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে আন্দোলনরত বিরোধী শক্তিকে সহজেই অবদমন করে তারা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। আর আত্ম বিশ্বাস অহমিকায় পরিণত হয়ে তাদের অন্ধ করে দেয়। এর ফলে কিছু নেতা ও আমলারা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নানান সামাজিক অপরাধ ও অর্থনৈতিক অনাচারে লিপ্ত হয়। দীর্ঘদিনের ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে তারা যেমন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যান, তেমনি গণমানুষের ভিতরে গড়ে উঠা ক্ষোভকে তারা বুঝতে ব্যর্থ হন। ফলশ্রুতিতে জনরোষের মুখে ছাত্র জনতা ও সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের পতন নিশ্চিত হয়।
💥জামায়াত-বিএনপি ও বামদের ভূমিকা:
বিগত বছর গুলোতে জামায়াত-বিএনপি প্রায় সমার্থক শব্দ হিসাবে পরিগণিত হলেও বর্তমানে তাদের মধ্যে আলাদা অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার জোড় তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াতকে যদি আলাদা করে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, বিএনপির আমল গুলোতে তাদের নানা দুর্নীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা এখনো মানুষ মনে রেখেছে। আওয়ামীলীগ সম্পর্কে মানুষের বর্তমান মোটিভ যেমন নেগেটিভ তেমনি বিএনপির ক্ষেত্রেও তারা পজিটিভ এমন ভাবার কারন নাই। সাধারণ মানুষের ধারণা এই দুটি দল মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। সুতরাং একদল চলে গিয়ে অন্য দল ক্ষমতায় গেলেই যে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে এমন ভাবনা ব্যাপক অধিকাংশ জনগণই ভাবেন না। বিশ্বাসও করেন না। যদিও তারা ইদানিং তাদের বহিরাবনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। তবে জনগণ কতটুকু গ্রহণ করবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। অন্যদিকে জামায়াতের প্রচার প্রচারণায় নানা নীতিবাক্য ও সুশৃংখলতা প্রকাশ পেলেও দলটির সদস্য ও সমর্থক ছাড়া সাধারণ জনগণ যাদের আমরা বলি ফ্লোটিং ভোটার তারা কিন্তু ভোটের বাক্সে জামায়াতকে ভোট দেন না। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের যেমন বিতর্কিত অবস্থান রয়েছে, তেমনি ভারত ভাগের সময়ও তারা মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্র তথা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিপক্ষে ছিলো। অর্থাৎ দলটি বরাবরই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হবার ইতিহাস রয়েছে। অপরদিকে কিছুটা একই কারণে বাম দল গুলোও মানুষের মন থেকে উঠে গেছে। ভাববাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের বস্তুবাদী মতবাদ প্রচার, বিশেষত নিরশ্বরবাদের প্রচার মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি, তেমনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদকে হটাতে গিয়ে ভারতের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় তারা ধীকৃত হয়েছে। অন্যদিকে তাদের রণনীতি ও রণকৌশল সমাজতান্ত্রিক না জনগণতান্ত্রিক হবে এই নিয়ে বিতর্ক করতে করতে টুকরো টুকরো দলে পরিণত হয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
💥অন্যান্য দলের ভূমিকা:
জাতীয় পার্টিসহ নতুন গড়ে উঠা রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি-আদর্শ আসলে কি, সেটি এখনো জনগণের কাছে স্পষ্ট না হওয়ায় তারা পালে হাওয়া পাচ্ছে না। ফলে নানা ভাবে গড়ে উঠা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এদেশের মানুষ সম্মিলিত ভাবে তাদের চাওয়া পাওয়ার কোন মতাদর্শিক দিশা না পেয়ে হতাশা হয়েছে। সাধারণ মানুষ তাদের চাওয়া পাওয়ার প্রতিচ্ছবি রূপে কোন রাজনৈতিক দল বা নেতা তারা আবিস্কার করতে পারেন নাই। ফলে মন্দের ভালোকেই তাদের বেছে নিতে হয়েছে।
💥অভ্যুত্থানের অবজেক্টিভ তৈরী-ই ছিলো:
তাহলে ছাত্র জনতা ও সেনাবাহিনীর এই অভ্যুত্থান সম্ভব হলো কি করে? কার্ল মার্কস একটা কথা বলেছিলেন, যার অর্থ দ্বারায় "কোনো বিপ্লবই নীরবে সংঘটিত হয় না, যখন তা ঘটে তখন উল্লম্ফন হয়।" অর্থাৎ বিপ্লব বা অভ্যুত্থান সংগঠনের সময় সমাজ বা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রচণ্ড জোড়ে একটা ঝাঁকুনি হবে। যার প্রকাশিত রূপ আমরা গত ৫ আগষ্ট এদেশেই দেখেছি । এখন প্রশ্ন হলো এই ঝাঁকুনি কি এমনি এমনি হয়? না এমনি এমনি হয় না। ভূমিকম্প হওয়ার পূর্বে যেমন বহু বছর ধরে শিলা খণ্ড সমূহ সংগঠিত হয় এবং একসময় প্রচণ্ড বেগে ও শব্দে তো বিস্ফোরিত হয়, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বছরের পর বছর ধরে গড়ে উঠা জ্বালা, যন্ত্রণা, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে একটা নির্দিষ্ট সময়। তখন যদি ঐ আন্দোলনের নেতৃত্ব জনসাধারনের চিন্তা চেতনা ও চাওয়া পাওয়াকে একটি সূত্রে গেঁথে দিতে পারে, তাহলেই বিপ্লব বা অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়ে যায়। অর্থাৎ পরিস্থিতি তৈরী হয়ে থাকে। নেতৃত্বশ্রেণী শুধু অনুঘটকের কাজ করে। সেটাই হয়েছে ৫ আগস্টের ছাত্র জনতা ও সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানে।
💥আন্দোলনের অভিনব কৌশল:
এই আন্দোলনে নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা যেমন একদমই অপরিচিত তেমনি তাদের আন্দোলনের কৌশল ছিলো ভিন্ন। তারা আন্দোলনকালীন সময় যে সকল শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন সেগুলো যেমন অভিনব তেমনি ওই সময় জনগণের ও শাসকদের পালস বুঝে বুঝে তারা কৌশল পরিবর্তন করেছিলেন। ফলে ছাত্র জনতা এটাই তাদের শেষ সুযোগ মনে করে ঝাপিয়ে পড়েছিল। অতপর রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর অন্যতম ভিত্তি "সেনাবাহিনী" যখন ছাত্র জনতার দিকে তাক করা অস্ত্র নামিয়ে ফেলে তখন একটি সফল গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।
💥করণীয়:
সুতরাং একথা যথার্থই বলা যায় যে, এদেশের ক্ষমতাসীনরা সহ রাজনৈতিক দল সমূহ সঠিক ভাবে এদেশের মানুষের চিন্তা চেতনা, চাওয়া পাওয়া না বুঝে বারবারই নিজেদের মতো করে গড়ে তোলা নানা মতাদর্শ জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস পেয়েছেন। এখন সময় এসেছে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ বিনির্মাণের। সে জন্য, রাজনৈতিক দল সমূহের তৈরী করা মতাদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিজেদের মতাদর্শিক ভাবনা পরিবর্তন করতে হবে। একই সথে আপামর জনসাধারণের ইচ্ছার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করতে হবে।
মীর এম এম শামীম। সমাজকর্মী।
প্রকাশক ও সম্পাদক- রবিউল ইসলাম। প্রধান কার্যালয়ঃ ২২ পশ্চিম-ধানমন্ডি, শংকর, ঢাকা-১২০৯। মোবাইল: ০১৭১৫-২০৯৬২৪। ফোন: +৮৮০২৯৫৫১৬৯৬৩ । ই-মেইল: alochitokantho@gmail.com । স্বত্ব © ২০২১ আলোচিত কন্ঠ
Copyright © 2024 আলোচিত কণ্ঠ. All rights reserved.