মৌলবাদ এমন একটি মতাদর্শ যা ধর্মীয় বা ঐতিহ্যগত বিশ্বাসের প্রতি কঠোর আনুগত্য দাবি করে। এটি সমাজে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে জোরদার করে এবং নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, নারীর ক্ষমতায়ন একটি প্রগতিশীল ধারণা, যা নারী-পুরুষের সমান অধিকার, স্বাধীনতা, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই দুই ধারার মধ্যে সংঘর্ষ আধুনিক সমাজে গভীর প্রভাব ফেলছে।
মৌলবাদের মূল বৈশিষ্ট্য এবং নারীর প্রতি এর দৃষ্টিভঙ্গি
১. নারীর ভূমিকা সংজ্ঞায়িত করা:
মৌলবাদী মতাদর্শ নারীর ভূমিকা সীমিত করে গৃহস্থালির কাজ এবং সন্তান লালন-পালনের মধ্যে। তারা বিশ্বাস করে যে নারীদের প্রাথমিক দায়িত্ব পরিবারে এবং পুরুষের অধীনস্থ থাকা।
উদাহরণ: অনেক মৌলবাদী গোষ্ঠী নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করে এবং তাদের বাইরে কাজ করা "অশোভন" বলে বিবেচনা করে।
২. শিক্ষার প্রতি বিরোধিতা:
মৌলবাদ প্রায়ই মেয়েদের শিক্ষাকে "প্রয়োজনীয় নয়" বলে মনে করে। তারা মনে করে যে নারীশিক্ষা তাদের ঐতিহ্যগত ভূমিকা থেকে বিচ্যুত করতে পারে।
উদাহরণ: আফগানিস্তানে তালেবান মেয়েদের মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
.৩ পোশাক এবং আচরণে নিয়ন্ত্রণ:
মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো নারীদের পোশাক এবং আচরণের উপর কঠোর নিয়ম আরোপ করে। এটি নারীদের স্বাধীনতার উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ।
উদাহরণ: বিভিন্ন দেশে নারীদের বোরকা বা হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যারা এই নিয়ম মানতে অস্বীকার করে, তারা প্রায়ই সামাজিকভাবে অপমানিত বা শাস্তির শিকার হয়।
৪. আইনি এবং সামাজিক অধিকার হরণ:
মৌলবাদ নারীদের আইনি অধিকারকে সীমিত করে। তারা নারীদের সম্পত্তির অধিকার, বিবাহবিচ্ছেদ, এবং কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাওয়ার বিরোধিতা করে।
উদাহরণ: অনেক মৌলবাদী সমাজে নারীকে আইনি সাক্ষ্য দেওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়।
৫. নারীর প্রতি সহিংসতা:
মৌলবাদী সমাজে নারীরা প্রায়ই সহিংসতার শিকার হয়। যারা এই মতাদর্শের বিরুদ্ধে কথা বলে বা তাদের নিয়ম মানতে অস্বীকার করে, তারা হুমকি, নির্যাতন, এমনকি হত্যার শিকার হয়।
উদাহরণ: মালালা ইউসুফজাইয়ের উপর হামলা নারীর শিক্ষার প্রতি মৌলবাদের বিরোধিতার একটি প্রতীকী উদাহরণ।
নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য এবং মৌলবাদের সাথে সংঘর্ষ
১. শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতায়ন:
নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান উপায় হলো শিক্ষা। শিক্ষা নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করে। তবে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো মনে করে যে শিক্ষিত নারী সমাজের নিয়ম-কানুন মানতে অস্বীকৃতি জানাবে।
সংঘর্ষের কারণ: মৌলবাদ নারীদের শিক্ষাকে তাদের ঐতিহ্যবিরোধী হিসেবে দেখে।
২. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা:
নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ তাদের আর্থিকভাবে স্বাধীন করে তোলে এবং পরিবার ও সমাজে তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে।
সংঘর্ষের কারণ: মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো মনে করে নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জন্য হুমকি।
৩. আইনি সমতা প্রতিষ্ঠা:
নারীর ক্ষমতায়ন মানে নারীদের জন্য সমান আইনি অধিকার নিশ্চিত করা। এটি মৌলবাদের বিরোধী, কারণ মৌলবাদ নারীকে পুরুষের অধীনস্থ রাখতে চায়।
৪. নারীর প্রতি সহিংসতার অবসান:
নারীর ক্ষমতায়ন এমন একটি সমাজ গড়তে চায় যেখানে নারীরা সহিংসতা থেকে মুক্ত থাকবে। তবে মৌলবাদী সমাজে নারীদের প্রতি সহিংসতা প্রায়ই সামাজিক নিয়ম বা ধর্মের নামে বৈধতা পায়।
মৌলবাদের কারণে নারীর ক্ষমতায়নের পথে বাধা
১. সমাজে ভয় এবং নিপীড়নের পরিবেশ তৈরি:
মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো নারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ভয় এবং নিপীড়নের পরিবেশ তৈরি করে।
উদাহরণ: ব্লগার বা নারী অধিকারকর্মীদের হত্যার হুমকি বা আক্রমণ।
২. সংস্কৃতি এবং ধর্মের অপব্যাখ্যা:
মৌলবাদীরা সংস্কৃতি এবং ধর্মকে অপব্যবহার করে নারীর অধিকার খর্ব করে।
উদাহরণ: শিশু বিবাহ এবং বহু বিবাহকে ধর্মীয় রীতির নামে সমর্থন দেওয়া।
৩. প্রগতিশীল আইন বাস্তবায়নে বাধা:
মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো প্রগতিশীল আইন, যেমন নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন বা কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার বিরোধিতা করে।
উপসংহার
মৌলবাদ এবং নারীর ক্ষমতায়নের সংঘর্ষ একটি দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক সমস্যা। মৌলবাদ যেখানে নারীকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়, সেখানে ক্ষমতায়ন নারীদের মুক্তি এবং সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। এই সংঘর্ষ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি শিক্ষিত, সচেতন সমাজ, যেখানে ধর্ম এবং সংস্কৃতির অপব্যাখ্যা প্রতিরোধ করা হবে। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য সরকার, সমাজ এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ একত্রে কাজ করতে হবে। তবেই আমরা একটি ন্যায়সঙ্গত এবং প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে পারব।
লেখক- প্রতিষ্ঠাতা, ভয়েস ফর অল, টরন্টো, কানাডা ।
প্রকাশক ও সম্পাদক- রবিউল ইসলাম। প্রধান কার্যালয়ঃ ২২ পশ্চিম-ধানমন্ডি, শংকর, ঢাকা-১২০৯। মোবাইল: ০১৭১৫-২০৯৬২৪। ফোন: +৮৮০২৯৫৫১৬৯৬৩ । ই-মেইল: alochitokantho@gmail.com । স্বত্ব © ২০২১ আলোচিত কন্ঠ
Copyright © 2025 আলোচিত কণ্ঠ. All rights reserved.