সাইফুর রহমান শামীম,, কুড়িগ্রাম।। ‘আমি আর ওই সংসারে যেতে চাই না। একজন নারী সহজে তার স্বামীকে ছাড়তে চায় না। কিন্তু এরকম নির্যাতন সহ্য করে কে সংসার করতে চাইবে? আমার প্রতি তার (স্বামীর) কোনও মহব্বত নেই। ওই সংসারে আবার গেলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। জীবন না বাঁচলে সংসারের মায়া করে কী হবে?’ কথাগুলো বলছিলেন স্বামী-শাশুড়ির নির্যাতনে হাসপাতাল ঘুরে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া বাল্যবিয়ের শিকার এক গৃহবধূ।
ভুক্তভোগী ওই গৃহবধূর বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঝুনকারচর গ্রামে। ২০১৮ সালে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সদরের ধরলা ব্রিজের পূর্বপাড়ে মাধব গ্রামের আফতার আলীর ছেলে হাবিবুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের তিন বছরেই দুই সন্তানের মা হন তিনি। কিন্তু দুই সন্তানের মা হওয়ার আনন্দ নিষ্প্রভ হয় স্বামী-শাশুড়ির ধারাবাহিক নির্যাতনে। নির্যাতনে অতিষ্ঠ এই গৃহবধূ আর সংসার করতে চান না। অভিযুক্ত স্বামী-শাশুড়ির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান তিনি।
সর্বশেষ গত ২৯ ডিসেম্বর স্বামী আর শাশুড়ি কিশোরী এই গৃহবধূকে নির্মম নির্যাতন করে দরজায় তালা দিয়ে ঘরবন্দি করে রাখে। দুই দিন পর গত ৩১ ডিসেম্বর প্রতিবেশীরা তাকে উদ্ধার করে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। পাশবিক নির্যাতনে প্রাণ হারাতে বসলেও দুই সপ্তাহেও মামলা করতে থানায় যেতে পারেনি ভুক্তভোগীর পরিবার। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের জবাব মেলে ভুক্তভোগী গৃহবধূর মায়ের কাছে।
ভুক্তভোগীর মা বলেন, ‘বয়স বাড়িয়ে মেয়ের জন্ম সনদ নিয়েছিলাম। কিন্তু ১৮ বছর না হওয়ায় সে সময় কাবিন করা হয়নি। এখন কাজি কাবিন দিতে গড়িমসি করছেন। কাবিন ছাড়া মামলা হবে কিনা সেটা ভেবে এখনও পুলিশের কাছে যেতে পারিনি।’
মেয়ের বাল্যবিয়ে দেওয়াকে নিজেদের সবচেয়ে বড় ভুল স্বীকার করে ভুক্তভোগীর মা আরও বলেন, ‘এখন সেই ভুলের মাশুল দিচ্ছি। মেয়ের দুটো বাচ্চার কথা চিন্তা করে ওকে বুঝিয়ে সংসারে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু এত মারলে মেয়েটা তো মরেই যাবে! আমরা অন্যায়ের বিচার চাই।’
ওই গৃহবধূ জানান, বিয়ের পর থেকে কথায় কথায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। কিন্তু দুই শিশু সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে সব সহ্য করে আসছিলেন। এর আগে আরও দুই বার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলেও স্বামীর বাড়ির লোকজন ভুল স্বীকার করে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু স্বামী ও শাশুড়ি কোনোভাবেই শোধরাচ্ছেন না। বরং নির্যাতনের মাত্রা আরও ভয়াবহ হচ্ছে।
সর্বশেষ নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে এই ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার শাশুড়ি দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে তার ছেলেকে (ভুক্তভোগীর স্বামীকে) বলেন, আমাকে এমনভাবে মারতে যেন আমার সংসার করার ইচ্ছা মিটে যায়। বাইরে থেকে যেন আমাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসতে না পারে সেজন্য বাড়ির মূল ফটকে দাঁড়িয়ে পাহারা দেন শাশুড়ি।’
‘স্বামী আমার চুল ধরে লাথি মারতে থাকেন। লাঠি দিয়ে আমাকে পেটান। মাটিতে ফেলে আমার গলায় এবং পেটে লাথি মারতে থাকেন। আমি যন্ত্রণায় তার পা ধরে নিস্তার চাইলেও তিনি আমাকে মারতে থাকেন। পেটে লাথি মারায় আমার রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পরে আমাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে বন্দি করে রাখা হয় যেন আমি বাবার বাড়িতে যেতে না পারি। আমাকে মারে আর বলে, দেখ, গাঁজা খাওয়া লোকের মার কেমন!’ মাদকাসক্ত স্বামীর অত্যাচারের মাত্রা ও ধরন বোঝাতে এভাবেই নির্যাতনের বর্ণনা দেন ওই কিশোরী গৃহবধূ।
‘নির্যাতনের কারণে এখন একটু হাঁটাহাঁটি করলেই আমার শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমি আইনের আশ্রয় চাই। স্বামী-শ্বাশুড়ির উপযুক্ত শাস্তি চাই, যেন তারা আর কোনও মেয়েকে এভাবে নির্যাতন করতে না পারেন।’ আকুতি জানিয়ে বলেন নির্যাতনে স্বামী-সংসারে বীতশ্রদ্ধ এই কিশোরী।
স্ত্রীকে নির্যাতনের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত হাবিবুর রহমানকে ফোন দিলে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তবে হাবিবুরের মা হাজেরা বেগম ছেলের হাতে পুত্রবধূ নির্যাতনের সত্যতা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘স্বামীর কথা শোনেনি বলেই মেরেছে। কিন্তু আমি তাকে মারিনি।’
এ বিষয়ে জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের উপপরিচালক (চ. দা.) শাহানা আক্তার বলেন, ‘আমরা ওই গৃহবধূ নির্যাতনের বিষয়টি এখনও অবগত নই। আমাদের কাছে আসলে ভুক্তভোগী গৃহবধূকে চিকিৎসা ও আইনি সহায়তার ব্যবস্থা নেবো।’
প্রসঙ্গত, কুড়িগ্রাম জেলা শাখা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই জেলায় ২৯৬ জন নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণ ও অন্যান্য নির্যাতনসহ মোট নির্যাতনের শিকার নারীর সংখ্যা ৩০২। আর জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, করোনাকালে জেলায় মোট বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে প্রায় চার হাজার স্কুল শিক্ষার্থী।