মোঃ কামাল হোসেন খাঁন মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধিঃ
মেহেরপুর পেঁয়াজের চারা বিক্রি ও পেয়াজ লাগানোর ধুম পড়ে গেছে। মেহেরপুরের মাটি পেঁয়াজসহ সকল ধরনের সবজি চাষের জন্যে উপযোগী। এ কারণেই মেহেরপুরের বিস্তীর্ন এলাকাজুড়ে চাষ হয় পেঁয়াজের।
গত একসপ্তাহ ধরে চলছে পেঁয়াজের চারা বিক্রি। চারা তৈরিতে অনেক ঝামেলা হওয়ায় অনেকেই চারা ক্রয় করেই লাগিয়ে থাকেন।
তাছাড়া চারা তৈরিতে পেঁয়াজের বীজের দামও কম নয়। চাষ, সার, বীজ, কীটনাশক, সেচ, লেবার সবমিলিয়ে চারা তৈরিতে ব্যাপক খরচ ও প্রতিনিয়ত চারার যত্নের জন্য সময়ও ব্যয় করতে হয়। একারণেই চারা তৈরির ঝামেলায় না গিয়ে অনেকেই বাজার থেকে পেঁয়াজের চারা ক্রয় করে থাকেন।
পেঁয়াজের চারা তৈরিতেও রয়েছে ঝুঁকি। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে গুনতে হবে বিরাট অংকের লোকসান। প্রতি বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করতে প্রয়োজন পড়ে ৩ কেজি বীজের। যার মূল্য প্রায় ২৪ হাজার টাকা বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। এতো টাকায় বীজ ক্রয় করে বপনের পর অতিবৃষ্টি হলেই সর্বনাশ। একারণেই চারা তৈরির পরিবর্তে অধিকাংশ কৃষকই বাজার থেকে ক্রয় করে থাকেন।
মেহেরপুর জেলার সদর, মুজিবনগর ও গাংনী উপজেলার প্রায় প্রতিটা গ্রামেই কমবেশি পেঁয়াজের আবাদ হয়ে থাকে। বাজারে বেশি মূল্যে পেঁয়াজ ক্রয়ের ভয়ে অনেকেই ২/৫ কাঠা কখনও ১০ কাঠা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করে থাকেন। এতে করে নিজেদের চাহিদা পূরণ করে বাকিটা বাজারে বিক্রি করে সে অর্থ দিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় অন্যান্য চাহিদাও মেটানোর একটা সুযোগ তৈরি হয়। সেজন্য ধনী-গরীব প্রায় সকল কৃষকরাই কমবেশি পেঁয়াজের আবাদ করে থাকেন।
প্রতি বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদে প্রায় ৮০ হাজার টাকা খরচ হয় বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। তাদের হিসাব অনুযায়ী, বীজ ২৪ হাজার টাকা, হাল চাষ, সার, সেচ, কীটনাশক মিলে প্রায় ২০ হাজার টাকা, লেবার ২০ হাজার এবং পেঁয়াজ তুলতে প্রায় ২০ হাজার টাকা। সর্বমোট প্রতি বিঘা জমিতে পেঁয়াজ বপন থেকে শুরু করে উত্তোলন পর্যন্ত প্রায় ৮০ হতে ৯০ হাজার টাকা মতো খরচ হয় বলে জানা যায়।
কৃষকরা পেঁয়াজ উত্তোলনের সময় লক্ষ্য করা গেছে, সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে ফলে দেশের আবাদ কৃত পেঁয়াজের মূল্য কমে যায়। এতে করে দেশের কৃষকরা তাদের পেঁয়াজের ন্যায্য মূল্য হতে বঞ্চিত হয়। আগ্রহ হারিয়ে ফেলে পেঁয়াজ চাষের উপর।
মেহেরপুর জেলার ভবানীপুর, বিশ্বনাথপুর, বসন্তপুর, শ্যামপুর, আনন্দবাস, বাগোয়ান, বাড়িবাঁকা, টেংরামারি, নিশ্চিন্ত পুর, গাড়াডোব, মনোহরপুর, কেদারগন্জ, বলিহারপুর, সাহারবাটী, মালশাদহ, আড়পাড়া, হাড়াভাঙ্গা, সোনাপুর, ইসলামপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, যখনই আমাদের পেঁয়াজ তোলার সময় হয়ে ওঠে ঠিক সে মুহূর্তেই সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে। ফলে আমরা পেঁয়াজ চাষিদের বিঘা প্রতি জমিতে প্রায় ৩০ হতে ৪০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়।
এসব পেঁয়াজ চাষিরা সরকারের প্রতি আকুল আবেদন জানান, যাতে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা না হয় তাহলে তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাবে বলে আশাবাদী।
এছাড়াও কৃষকদের মাঝে কিছুটা সার, কীটনাশক ও সহজ শর্তে কৃষি ঋণের ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন তারা। যাতে করে পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ বাড়ে এবং লাভবান হন।
তবে এখনই পেঁয়াজ তোলা শুরু হয়নি। চলছে পেঁয়াজ লাগানোর মৌসুম। গত এক সপ্তাহ ধরে চলছে পেঁয়াজের চারা বিক্রি ও ক্রয়ের ধুম। যারা পেঁয়াজের চারা তৈরি করেছেন তারা ব্যস্ত সময় পার করেছেন মাঠে চারা বিক্রিতে। পাইকাররা ভীড় জমিয়েছেন মাঠে মাঠে চারা ক্রয় করে মেহেরপুরসহ দেশের অন্যান্য জেলায়ও বিক্রির জন্য।
মুজিবনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামের জনৈক ব্যবসায়ী জানালেন, তিনি পেঁয়াজের চারা ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা করেন। মৌসুম এলেই পেঁয়াজের চারা ক্রয় করে নিয়ে যান শিবপুর গলাকাটা মোড়ে। সেখানে মাগুরা, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা আসেন চারা ক্রয়ের জন্য। আশেপাশের গ্রাম থেকেও চাষিরা আসেন তাদের প্রয়োজন মতো চারা ক্রয়ের জন্য। প্রতি মণ পেঁয়াজের চারা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় ক্রয় করেন এবং তা প্রতি মণ ৬০০ থেকে ৭০০ কখনও ৮০০ টাকায় বিক্রি করেন। খুচরা বাজারে ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকায় প্রতি কেজি দরে চারা বিক্রি করেন।
এবছরে চারার মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আছে বলে আরেক ব্যবসায়ী জানালেন। তিনি জানান, একই সময়ে গতবছর প্রতি মণ ভারতীয় জাতের “সুখ সাগর” পেঁয়াজের চারা বিক্রি করেছেন প্রায় ৫০০০ টাকায়। খুচরা বাজারে বিক্রি করেছেন ১৫০ টাকা প্রতি কেজি।
প্রতিদিনই শ্যালো ইঞ্জিন চালিত আলগামন লোড হয়ে, কোথাও কোথাও পাখি-ভ্যান লোড হয়ে যাচ্ছে শিবপুর গলাকাটা মোড়সহ ভাটপাড়া ডিসি ইকো পার্ক সংলগ্ন বাজার, বামুন্দী বাজার, হেমায়েতপুর বাজার, গাংনী উপজেলা শহরের বাজার, মেহেরপুর শহর ছাড়াও জেলার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাজারে। ক্রেতারা কিনছেন তাদের চাহিদা অনুযায়ী।
তবে সকলেরই দাবি, পেঁয়াজ উত্তোলনের সময় ভারত থেকে যেন আমদানি না করা হয়। বাংলাদেশের কৃষকরা পেঁয়াজ চাষ করে যাতে ক্ষতিগ্রস্হ না হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মেহেরপুরের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার খাঁ জানান, চলতি মৌসুমে জেলার সদর, মুজিবনগর ও গাংনী উপজেলায় প্রায় ৩ হাজার ১শত হেক্টর জমিতে পিঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বাম্পার ফলন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাধারণ চাষিরা আশাবাদী কৃষকরা যাতে পেঁয়াজ চাষ করে তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় এবং পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে, সে ব্যাপারে সরকার সজাগ থাকবেন।