মোঃ খলিলুর রহমান সাতক্ষীরা::
প্রশাসনের সঠিক নজরদারি না থাকায় ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়াই সাতক্ষীরা শহরসহ সাত উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পর্যায়ের হাটবাজার ও অলিগলিতে এবং বাসাবাড়িতে হোমিও ফার্মেসী রয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক। এরমধ্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে নেওয়া ড্রাগ লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ৮০টির। বিপুল পরিমাণ হোমিও ফার্মেসী এখনো ওষুধ প্রশানের তদারকির বাইরে রয়েছে। এসব ফার্মাসির বিরুদ্ধে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ইউনানী ও যৌন উত্তেজক ট্যাবলেটসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর রোগের ওষুধ সরবরাহ করা হয়। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে সাধারণ রোগীর। এদিকে ফার্মেসী চালু করার জন্য ডিএইচএমএস/বিএইচএমএস সার্টিফিকেটধারী থাকা বাধ্যতামূলক হলেও তা মানা হচ্ছে না। অল্প শিক্ষিত ও ওষুধ সম্পর্কে সীমিত ধারণাসম্পন্ন লোকবল দিয়েই চলছে এসব হোমিও ফার্মেসীর ব্যবসা। অপরদিকে জেলায় নিম্ন আয়ের মানুষের চিকিৎসাসেবার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে লাইসেন্সবিহীন এসব হোমিও ফার্মেসি বা কথিত চিকিৎসক। হোমিও ফার্মেসীগুলোতে কোনো ধরণের ডিএইচএমএস/বিএইচএমএস সার্টিফিকেটধারী না থাকলেও সবধরণের রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর এভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য ওধুষ প্রশাসনের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় সরকারিভাবে ড্রাগ লাইসেন্সধারী হোমিও ফার্মেসি রয়েছে প্রায় ৮০টি। এছাড়াও ড্রাগ লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আরও প্রায় ৮/১০টি আবেদন জমা আছে। যদিও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এর নিয়ম অনুযায়ী ওষুধের দোকান চালু করতে হলে ‘দি বেঙ্গল ড্রাগস রুলস ১৯৪৬’ অনুযায়ী অবশ্যই ড্রাগ লাইসেন্স নিতে হবে। যেহেতু সিডিউল সি(১)ভুক্ত, সিডিউল বহির্ভূত ওষুধ বিক্রয় ও বিক্রয় প্রদর্শনের নিমিত্তে মওজুদ এবং বিতরণের লাইসেন্স ওষুধ আইন ১৯৪০ বিধি অনুযায়ী জৈব ও অজৈব ওষুধ বিক্রয়ের অনুমতি স্বরূপ নবায়নযোগ্য দুই বছর মেয়াদ কাল পর্যন্ত লাইসেন্স প্রদান করা হয়ে থাকে। ঔষধ আইনের অধ্যাদেশ ১৯৮২ অনুযায়ী লাইসেন্সে বর্ণিত সকল শর্তসমূহ মেনে চলতে হয়। ড্রাগ লাইসেন্স ফার্মেসির দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শনের নিয়ম থাকলেও সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ ফার্মেসিতে নেই ড্রাগ লাইসেন্স।
সাতক্ষীরা পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, পৌর অভ্যন্তরের হোমিও ফার্মেসীগুলোর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করেছে মাত্র ১২ টি হোমিও ফার্মেসি। অধিকাংশ হোমিও ফার্মেসীতেই ডিএইচএমএস/বিএইচএমএস সার্টিফিকেটধারী না থাকায় অল্প শিক্ষিত লোকবল দিয়ে চলছে ব্যবসা। এজন্য অনেক সময় রেজিস্ট্রার্ড হোমিও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র না বুঝে ভুল ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে রোগীদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক হোমিও চিকিৎসক জানান, একজন চিকিৎসক সেবার ব্রত নিয়ে চিকিৎসা পেশা শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত সেবার মনোভাব উবে গিয়ে ব্যবসায়িক হয়ে যান কিংবা হতে বাধ্য হন। তার বহি:প্রকাশ এ্যালোপ্যাথিতে বেশি। অথচ এই প্যাথির ফার্মেসী ব্যবসায়ী বা চিকিৎসকদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বিভিন্ন সভা-সেমিনার বা ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেন। অথচ সেই ক্ষেত্রে হোমিও ফার্মেসী বা চিকিৎসকরা সর্বদা বঞ্চিত। আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কোনো উদ্যোগ নেয় না প্রশাসন। আগে সচেতনতা বৃদ্ধি করুক সেই প্রত্যাশা।
হোমিও চিকিৎসক সৈয়দ সায়েম আলী জানান, পূর্বে একজন হোমিও চিকিৎসকের চেম্বারে ড্রাগ লাইসেন্স রাখার বিধান কিংবা প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এখন হোমিও চেম্বারে ওষুধ রাখতে গেলে অবশ্যই ওই চিকিৎসক বা ফার্মেসী মালিকদের ড্রাগ লাইসেন্স করতে হবে বাধ্যতামূলক। তবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের ড্রাগ লাইসেন্স প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে নানান জটিলতা। এমনকি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও অধিকাংশ চিকিৎসক বা ফার্মেসী মালিকদের এই বিষয়ে কিছু বলেন না। ফলে ওই মালিক বা চিকিৎসকরা ড্রাগ লাইসেন্স সম্পর্কে না জেনে তাদের চেম্বারে এবং ফার্মেসীতে হোমিও ঔষধ বিক্রি করে। আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মালিক বা চিকিৎসকদের উদ্বুদ্ধ করুক। তাহলে সকলে ড্রাগ লাইসেন্স করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। এদিকে সুলতানপুর কাজী পাড়ার বাসিন্দা ডাবলু জানান, ওষুধের দোকানের নিয়ম ভঙ্গ করে উপজেলা গেটে সাইমুন ফটোষ্ট্যাটের আড়ালে হোমিও ঔষধের দোকান করেছে মুনজিতপুর গ্রামের সারাফাত। সে ডাক্তারী পড়ালেখাও করেনি, একাডেমিক কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই। অথচ ওষুধের দোকান করার সুবাদে এখন নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে চিকিৎসার নামে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। এছাড়াও হোমিও ফার্মেসির সাথে একই দোকানে অন্য ব্যবসাও করছেন। আপনারা লিখলে প্রশাসন অভিযান চালালে পূর্বে যেভাবে ভুয়া ডাক্তার ধরা পড়েছে এভাবে অনেক ভুয়া ডাক্তার ধরা পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ জানান, কোনো রোগী একজন এ্যালোপ্যাথি ডাক্তারের কাছে গেলে ওই ডাক্তারের পরামর্শ ফ্রি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়। এছাড়াও চিকিৎসক বিভিন্ন টেস্ট লিখে দেন। যা করতে প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ হয় ওই রোগীর। তাই তৃণমূল রোগীদের আশা-ভরসার একমাত্র স্থল পল্লী ও হোমিও চিকিৎসা। ওই চিকিৎসা গ্রহণের জন্য তারা হোমিও ডাক্তারদের কাছে যায় এবং তাদের কাছ থেকে সামান্য টাকায় ঔষধ কিনে খেয়ে শত শত রোগী আরোগ্য লাভ করে। অথচ ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদাসীনতার জন্য ওই হোমিও চিকিৎসক বা মালিকদের ড্রাগ লাইসেন্স এর আওতায় আনা হচ্ছে না। এমনকি তাদেরকে ড্রাগ লাইসেন্স করার বিষয়েও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্ভুব্ধ করে না। ফলে বছরের পর বছর সরকার হারায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
ড্রাগ সুপার মীর আব্দুর রাজ্জাক জানান, কতগুলো হোমিও ফার্মেসী আছে তা বলা মুশকিল। তবে জেলায় ড্রাগ লাইসেন্সপ্রাপ্ত হোমিও ফার্মেসীর সংখ্যা প্রায় ৮০টি। এর বাইরে লাইসেন্সবিহীন যত্রতত্র হোমিও ফার্মেসী খুলে যারা ব্যবসা করছে তাদের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার চেষ্টা করব।
সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত জানান, ১৯৪০ সালের ওষুধ নীতি ১৯৮২ সালে সংশোধিত হয়, যেখানে বলা হয়, একজন চিকিৎসক শুধুমাত্র প্রেসক্রাইব করবেন। তবে ঔষধ বিক্রি করতে পারবেন না। একজন চিকিৎসক যদি এক শিশিও ঔষধ চেম্বারে রাখেন তাহলে তাঁকে অবশ্যই ড্রাগ লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। তবে সেই নিয়ম মানেন না জেলার অধিকাংশ ফার্মেসী ব্যবসায়ী ও চিকিৎসকরা। ফলে যত্রতত্র ফার্মেসীগুলোতে রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই বিক্রি করা হয় ওষুধ। এতে করে প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ রোগীরা। ওই রোগীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতেরর জন্য ফার্মেসী ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনা জরুরী।