স্বপন কুমার রায় খুলনা ব্যুরো প্রধান
ত্রিমুখী সংকটে খুলনার তরমুজ চাষ, ফিকে হয়ে যাচ্ছে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন তীব্র সেচ সংকট, স্থানীয় পানির উৎস্য খাল-নদী অবৈধ দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি শূন্যতা এবং অনাবৃষ্টিতে তাপদাহের কারনে ভাইরাসের সংক্রমনে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে খুলনার তরমুজ চাষ। এ বছর খুলনায় ৭’হাজার ৬০৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হলেও তরমুজের ফলন ও আশানুরূপ উৎপাদন নিয়ে শংকায় পড়েছেন চাষীরা। এতে ফিকে হয়ে আসছে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন।
তরমুজ চাষের এই সংকট সমাধানে সরকারীভাবে তেমন কোন উদ্যোগ না থাকায় জেলার ৬’উপজেলার পাচ সহস্রাধিক তরমুজ চাষির মাঝে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। এই অবস্থায় সেচের পানির সংকট সমাধানে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে স্থানীয় খাল-নদীগুলো পুন:খনন এবং গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী তরমুজ চাষীদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিভাগের মধ্যে খুলনায় সবচেয়ে বেশি তরমুজের চাষ হয়। খুলনায় এ বছর প্রায় ৮’হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের তরমুজের আবাদ হয়েছে।খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, রূপসা, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এ বছর তরমুজ চাষ হয়েছে।এরমধ্যে দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে।গত বছর দাকোপে ১’হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছিল।এবার সেখানে ৩’হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে।জেলার মোট উৎপাদিত তরমুজের ৭০থেকে ৭৫শতাংশ দাকোপ উপজেলায় উৎপাদিত হয়। একইভাবে বটিয়াঘাটায় চলতি মৌসুমে ২’হাজার ১৫০ হেক্টর তরমুজের চাষ হয়েছে। এছাড়া কয়রায় ৬৫০ হেক্টর, ডুমুরিয়ায় ২৩০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে।
গত এক দশকের মধ্যে ২০১৪ সালে জেলায় সবচেয়ে বেশী ৩’হাজার ৪৬৮ হেক্টর জমিতে তরমুজ হয়েছিল। তবে সেবার ফসল তোলার সময় বৃষ্টি ও খারাপ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কৃষকেরা চরম ক্ষতির মুখে পড়ে। ফলে ২০১৫ সালে তরমুজের আবাদ আগের বছরের তুলনায় কমে ছয় ভাগের এক ভাগে এসে দাড়ায়। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে তরমুজের আবাদ আবার বাড়তে থাকে। গত বছর প্রায় ৪’হাজার হেক্টর জমিতে ১’লাখ ২০ হাজার টন তরমুজ উৎপাদিত হয়েছিল।
এলাকার কৃষকরা জানান, লবনাক্ততা ও খরার কারনে খুলনার উপকূলীয় এলাকায় বছরে একটি মাত্র ফসল আমন ধানের চাষ হয়ে থাকে। আমন পরবর্তী সময়ে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা পতিত থাকত। গত কয়েক বছর ধরে কৃষি বিভাগ ও মৃত্তিকা উন্নয়ণ গবেষনা ইনষ্টিটিউটের সহযোগীতায় উপকূলীয় এলাকায় তরমুজ চাষ শুরু হয়। তরমুজ চাষ করে অল্প সময়ে বেশি লাভ পাওয়ায় দিন দিন আবাদ যেমন বাড়ছে। তেমনি কৃষকের মাঝে জনপ্রিয় হচ্ছে তরমুজ চাষ।
উপকূলীয় দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে তরমুজ চাষ এখানকার কৃষকের প্রধান ফসল হয়ে দাড়িয়েছে। প্রতি বিঘায় আমন ধান উৎপাদনে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয় এবং সময় লাগে ০৫ মাস। এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করে সর্বোচ্চ ১৮’হাজার টাকা পাওয়া যায়। সেখানে তরমুজের বীজ বোনা থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত সময় লাগে সর্বোচ্চ ৯০ দিন। প্রতি বিঘায় তরমুজ চাষে খরচ হয় ১’হাজার ২১৪ টাকা। আর প্রতি বিঘায় উৎপাদিত তরমুজ বিক্রি হয় সর্বনিন্ম ৩৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৮৫ হাজার টাকা। লাভ বেশি হওয়ায় তরমুজের আবাদ বেড়েছে। তবে গত কয়েক মাস বৃষ্টি না হওয়ায় তীব্র তাপদাহ এবং স্থানীয় পানির উৎস্য নদী-খালগুলো অবৈধ দখল ও ভরাট হয়ে শুকিয়ে যাওয়ায় সেচের পানির অভাব এবং ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গাছ মরে যাচ্ছে। সরকারের পানি উন্নয়ণ বোর্ড, বিএডিসি, কৃষি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ঠ দপ্তরে ধর্না দিয়েও সেচের পানির সংস্থান করতে পারছে না চাষীরা। আর্থিকভাবে লাভবান ও রঙীন স্বপ্ন নিয়ে উপকুলের হাজার হাজার চাষী তরমুজ চাষ করলেও তা এখন দু:শ্চিন্তার কারন হয়ে দাড়িয়েছে।তরমুজ চাষিদের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। সেচের পানির অভাবে কৃষকের স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে।
দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলার অন্তত তরমুজ চাষিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ জমির তরমুজ গাছ বড় হয়ে গাছে ফুল ও ফল এসেছে। কিছু খেতে তরমুজ বড় হয়েছে।পানি, সার ও কীটনাশক ছিটিয়ে পোকামাকড়মুক্ত রাখতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। প্রচন্ড তাপে এবং দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় মাঠের ভেতরের সরকারী জলাশয়গুলো শুকিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও অবৈধ দখল ও ভরাটের কারনে নদী-খাল পানি শূন্য। ফলে দেখা দিয়েছে সেচের পানির তীব্র সংকট। অনেকে ছোট ছোট কুয়ো কেটে সেচ দিচ্ছেন।কিন্তু তীব্র তাপদাহের কারনে সে পানির আধারগুলোও এখন শুকিয়ে গেছে।
দাকোপের পশ্চিম বাজুয়া গ্রামের তরমুজ চাষি কুশল গাইন জানান, এবার এলাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় ৩/৪গুন বেশী পরিমাণে তরমুজ আবাদ হয়েছে। এজন্য পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেতে গাছ মরা শুরু করেছে। অধিকাংশ খাল-নদী সব শুকনা। স্থানীয় কচা ও ভাইজুড়ি খালে শত শত পাম্প মেশিন বসানো। সেখান থেকে কোনোমতে পানি তোলা হচ্ছে।কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় সেখানেও প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
দাকোপের তরমুজ চাষি সরোজিত মন্ডল জানান, তিনি ১২’বিঘা জমিতে তরমুজের আবাদ করেছেন।যদি বৃষ্টি না হয় তবে গাছ বাঁচবে না। তরমুজ গাছ মরে সবই সাবাড় হয়ে যাবে।পাশের বাঠাকাটা, কাটাখালি, কাঁকড়াবুনিয়া, কালিতলা খালেও পানি নেই। তরমুজ ক্ষেতে সেচ দেওয়ার জন্য এলাকার প্রায় চার হাজার কৃষক পানি পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যেই চাষীরা কৃষি বিভাগ, বিএডিসিসহ বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেও সেচের পানির কোন সুরাহা করতে পারেনি। ফলে একমাত্র বৃষ্টির উপরই আশা করে রয়েছেন এলাকার চাষীরা।
কৈলাশগঞ্জের তরমুজ চাষি শৈতাপ গায়েন জানান, তিনি ৭’বিঘা জমিতে তরমুজের চাষ করেছেন। বৃষ্টি না হওয়ায় এলাকায় এখন পানির তীব্র সংকট। চড়া নদীর অধিকাংশ স্থানের পানি শেষ।পাশের তক্তামারী খালও শুকিয়ে গেছে। বৃষ্টি না হলে গাছ বাঁচানোর আর কোন পথ থাকবে না। প্রচন্ড খরার কারনে তরমুজ গাছে ভাইরাস দেখা দিয়েছে। গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে, ফল মরে ঝরে যাচ্ছে।সরকারীভাবেও সেচ সংকট মোকাবেলার জন্যও কোন ব্যবস্থা তারা পাচ্ছেন না।