মোঃ মজিবর রহমান শেখঃদেশের চতুর্থ চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে ঠাকুরগাঁও জেলা। জানা যায়, ১৯৯৯ সালে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় জরিপ চালায় বাংলাদেশ চা বোর্ড এবং চা গবেষণা ইনস্টিটিউট। ২০০০ সালের দিকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। পরে ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় প্রথম চা চাষ শুরু হয়। এখন ঠাকুরগাঁও জেলার প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামে চা চাষ হচ্ছে। এসব বাগানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং শত শত শ্রমিক কাজ করে জীবন নির্বাহ করে আসছে। কিন্তু কাঁচা চা পাতার দাম অনেক কম হওয়ায় ঠাকুরগাঁও জেলার চা চাষ করে বিপাকে পড়েছে স্থানীয় চা চাষীরা। কাঁচা চা পাতা আহরণের ভরা মৌসুমে হঠাৎ করে চা পাতার দর অর্ধেকে নেমে আসায় চা চাষীরা হতাশ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। গত বছর একই সময়ে স্থানীয় চা কারখানাগুলো প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা ২২ টাকা থেকে ২৪ টাকা দরে কিনলেও এবার একই বাগানে তোলা কাঁচা চা পাতা বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ টাকা কেজি দরে। আবার প্রতি একশত কেজিতে ২০ কেজি কর্তন করা হচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলার আখানগরের চা চাষি রেজাউল করিম বলেন, স্থানীয় চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলো বিভিন্ন কৌশলে সিন্ডিকেট করে নিজেদের লাভের অংক বাড়াতে এমন অপকৌশল গ্রহণ করেছে। অযুহাত হিসেবে কারখানা কতৃর্পক্ষ বলছেন, এবার উৎপাদিত কাচাঁ চা পাতার মান ভালো না হওয়ায় এবং মার্কেটের নিলামে ভালো দাম না পাওয়ায় এবার কাঁচা চা পাতার দাম কমানো হয়েছে। প্রতি একশত কেজি কাঁচা চা পাতায় ২০ কেজি পর্যন্ত কর্তন করা হচ্ছে। রুহিয়া এলাকার চা চাষী রহমান বলেন, বর্তমান যে দরে চা পাতা বিক্রি করতে হচ্ছে তাতে আমারা লাভের পরিবর্তে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। তিনি সংবাদ মাধ্যমের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আপনি চা চাষিদের দিকে তাকিয়ে দেখেন আমরা বর্তমানে কত অসহায়ের মধ্যে আছি। কশালগাঁও এলাকার চা চাষী কাসেম বলেন, চায়ের বাগান পরিচর্যা, সার ও বালাইনাশক ঔষধ, পাতা উত্তোলন ও পরিবহন খাতে যে খরচ হয় সেখানে কাঁচা চা পাতা বিক্রি করে সেই খরচ মেটানোয় কঠিন হয়ে পরছে। লাভের অংক দূরের কথা আসল তোলাই মুসকিল হয়ে পরছে ।
চা চাষী ও ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলা চা চাষী কল্যান সমিতির আহবায়ক রিপন জানান, বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলো নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে চা চাষীদের আর্থিক ক্ষতি করে নিজেরাই আর্থিক লাভের অপকৌশল গ্রহণ করেছে এতে করে আমারা চা বাগান মালিক ও চাষিরা চরম ভাবে আর্থিক সংকটে আছি। আমি মনে করি কমপক্ষে ২৫ টাকা প্রতি কেজি করা হোক আমি ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলা চা চাষি সমিতির আহবায়ক হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি আপনি একটু আমাদের দিকে খেয়াল করেন নইলে চা চাষিরা আরও বিপদগ্রস্ত হবে। আরও বলি চা একটা রাষ্ট্রীয় সম্পদ এটাকে বাঁচাতে হবে নইলে রাষ্ট্রেরেই অর্থনৈতিক সংকটে পরবে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত কৃষক এবং কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এআইপি পদক পাওয়া কৃষক মেহেদী আহসান উল্লাহ চৌধুরী বলেন, কর্মসংস্থানের নতুন পথ সৃষ্টি হওয়ায় ঠাকুরগাঁও জেলার কয়েক হাজার শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত বেকার মানুষ কাজের নতুন ক্ষেত্র খুজে পায়। শুধু তাই নয়, ঘরে বসে থাকা কর্মহীন নারীরা বাড়ির পাশের চা বাগানে চা পাতা তোলার কাজ করে বাড়তি আয় করে স্বচ্ছলতার পথ খুঁজে পেয়েছে। অন্যান্য ফসলের চেয়ে চা চাষ লাভজনক হওয়ায় দ্রুতই চা চাষের পরিধি যেমন বেড়েছে তেমনি নতুন নতুন চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানাও গড়ে উঠার প্রয়োজন। আর গত বছরের তুলনায় এ বছর কাঁচা চা পাতার দাম কম হওয়ায় বিপদে আছি আমরা চা চাষিরা অপর দিকে কীটনাশক, সার সহ যাবতীয় জিনিস পত্রের মূল্য উর্ধগতি তাহলে কেমনে সুখে থাকবে চাষিরা। ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষ্ণ রায় বলেন, ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলায় ৫৭.৭২ হেক্টর জমিতে ছোট-বড় মিলে ৯৩টি চা বাগান রয়েছে। তবে যেহেতু চা চাষের বিষয় চা বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করেন তারপরও আমার ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলা কৃষি অফিস থেকে চাষিদের সঠিক পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করছি।
ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ –পরিচালক ড. মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ জানান, ঠাকুরগাঁও জেলা একটি সমতল ভূমি এই এলাকায় ধান,গম,আলু,ভুট্টার পাশাপাশি চা চাষে বেশ উপযোগী হওয়ায় ঠাকুরগাঁও জেলায় অনেকে চা চাষে উৎসাহিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ঠাকুরগাঁও জেলায় ২৪১ হেক্টর জমিতে বানিজ্যিক ভাবে চা চাষ করছেন স্থানীয় চা চাষিগণ। পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ড জানায়, পঞ্চগড় জেলায় ২১ টি ও পাশ্ববর্তী জেলা ঠাকুরগাঁও ১ টি উৎপাদিত চা প্রক্রিয়াকরণ করার জন্য মোট ২২ টি কারখানা তাদের উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আরও ২০ টি কারখানা স্থাপনের জন্য অনুমতি নিয়েছেন। কারখানার সংখ্যা বেশি হলে চাহিদার সৃষ্টি হবে তখন চাহিদা অনুযায়ী পাতার দামও বৃদ্ধি পাবে।
পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ডের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন জানান,কাচা চা পাতার দর ওয়াকশনের মাধ্যমে হয়,তবে কাঁচা চা পাতার দাম কমার কিছু কারণও আছে যেমন আমাদের উত্তর বঙ্গের চা চাষিগণ দুই থেকে তিন পাতার মধ্যে কাঁচা চা পাতা আহরণ না করে ৪/৫ পাতা হওয়ার পরে আহরণ করে থাকেন কিন্তু সিলেট সহ অন্য এলাকায় দুই থেকে তিন পাতার মধ্যে কাঁচা চা পাতা আহরণ করে থাকেন। তারপরও আমরা চা চাষী ও কারখানা কর্তৃপক্ষদের সাথে নিয়ে বিষয়টির সুরাহা করার চেষ্টা করব। শতকরা ২০% কর্তনের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন,কোন চা কারখানা শতকরা ২০% কর্তন করতে পারবেন না তবে যদি চা পাতা ভিজে থাকে তাহলে ৫-৭ % কর্তন করতে পারেন। তবে চা চাষের সংশ্লিষ্টরা বলছেন,হঠাৎই চা কারখানা কর্তৃপক্ষ কাঁচা চা পাতার দর কমানোর কারণে চাষীরা বাগান পরিচর্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে চা বোর্ডর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যহত হতে পারে। ফলে পুনরায় চা আমদানি করে দেশের বাড়তি আমদানি ব্যয় করতে হবে। এতে দেশে রেমিটেন্সেও পড়বে বাড়তি চাপ।