মোঃ মহিউদ্দিন,ভোলা সদরঃবিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মরহুম অধ্যক্ষ আবদুল হক তাঁর জীবনকালে বর্তমান ভোলা জেলা ও বিভাগীয় শহর বরিশালে একজন সৎ, ন্যায়বান, কর্তব্যনিষ্ঠ দক্ষ শিক্ষা-প্রশাসক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন ।১৯০৩ সালে সাবেক ভোলা থানাধীন কুচিয়ামোড়ার হাজীপুর গ্রামের এক সমৃদ্ধ কৃষক পরিবারে পেয়ার আলী মোল্লা ও জোহরা খাতুনের ঘরে আবদুল হকের জন্ম। তাঁর পিতা স্বল্প শিক্ষিত হলেও স্বগ্রামে একজন সহিত্যানুরাগী ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তি বলে পরিচিত ছিলেন। বাল্যকালে আবদুল হক কুচিয়ামোড়ার হাজীপুর প্রাইমারী স্কুল হতে বৃত্তি নিয়ে উলানিয়া করোনেশন উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মুসলমান ছেলেদের মেধা ইংরেজী-মাধ্যমে লেখাপড়া করার উপযুক্ত নয়, এই যুক্তিতে পিতা তাঁকে উচ্চ = ইংরেজী বিদ্যালয়ে পড়াতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি জেদের বশবর্তী হয়ে নোয়াখালি সুধারাম হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে বৃত্তিসহ এম ই পাশ করেন। অতঃপর ১৯২৬ সালে বরিশাল গোয়েবর জর্জ ইনস্টিটিউট হতে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ১৯২৮ সালে উক্ত কলেজ হতে আই এ এবং ১৯৩০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বি এ পাশ করেন। ১৯৩৩ সালে দর্শন শাস্ত্রে এম এ পাশ করার পর তিনি আইন শাস্ত্রে ভর্তি হন । ১৯৩৫ সালে তিনি আইন পরীক্ষার ১ম পর্ব পাশ করেন। এসময় তাঁর পিতৃ বিয়োগ হলে তিনি দেশে ফিরে এসে শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেন। দৌলখাঁন হাই স্কুলে শিক্ষকতা কালে ১৯৩৮ সালে তিনি বিটি পাশ করেন। ১৯৪০ সালে প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হওয়ার পর পুরাতন দৌলখাঁন নদীগর্ভে বিলীন হলে তাঁর অসীম ধৈর্য ও পরিশ্রমের ফলে বর্তমান নতুন দৌলতখাঁয় হাই স্কুলটি স্থানান্তরিত ও পুনঃস্থাপিত হয়। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি দৌলতখান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অনেক জনকল্যাণমূলক সামাজিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত থাকেন।মহাযুদ্ধোত্তর দুর্ভিক্ষ পীড়িত দৌলখাঁ থানায় সরকারী ত্রাণ সরবরাহের দায়িত্ব সততার সাথে সম্পন্ন এবং ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে দ্রুত তৎপর হওয়ার জন্য তিনি একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিরূপে পরিচিত হন। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে আবদুল হক মাষ্টার নামে ভোলা মহকুমার শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই তাঁকে চিনত।
১৯৫২ সালে তিনি চরফ্যাশন হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এখানে শিক্ষকতার পাশাপাশি স্কুলটির সংস্কারের কাজে সফলতা অর্জন করেন। পরীক্ষায় ফলাফল ও অবকাঠামোর মান বিচারে একটি তৃতীয় শ্রেণীর স্কুল হতে চরফ্যাসন স্কুলটি একটি প্রথম শ্রেনীর উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয় তাঁর চেষ্টায় ও তত্ত্বাবধানে। এ স্কুল হতে সর্বপ্রথম ১৯৫ সালে একটি মেয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করে এবং ১৯৫৯ সালে একটি মেয়ে সারা বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। বস্তুতঃ দৌলতখাঁন ও চরফ্যাশন হাইস্কুলে সর্বপ্রথম সহ-শিক্ষা প্রবর্তনের একক কৃতিত্ব ছিল প্রধান শিক্ষক আবদুল হক সাহেবেরই। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে এ ধরণের একটি সামাজিক স্পর্শকাতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে তিনি তৎকালে যথেষ্ঠ বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
১৯৬২ সনের ১৫ই সেপ্টেম্বর তিনি ভোলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষের পদে যোগদান করেন । ভোলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সামান্য কিছুদিন বরিশালে বসবাস করেন। এসময় ১৯৬৩ সালে তাঁর কয়েকজন কর্মজীবী ছাত্রের শিক্ষালাভের
আকাঙ্খায় বরিশাল নাইট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় । তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব আবদুল হককে কলেজটি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বভার গ্রহণের অনুরোধ জানান । তাঁর প্রাক্তন ছাত্রদের কল্যাণার্থে তিনি এ গুরু দায়িত্বের ভার কাঁধে তুলে নেন। বরিশাল নাইট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষরূপে তিনি ১৯৬৩ হতে ১৯৭২ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন । এ সময়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সর্বাপেক্ষা শোকাবহ ঘটনাটি ঘটে। তাঁর প্রিয়তম বড় জ্যেষ্ঠ পুত্র আনোয়ারুল হক স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম লগ্নে বরিশাল শহর প্রতিরক্ষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৯শে মার্চ বোমার আঘাতে শহীদ হন ।
১৯৭২ সালে শিক্ষকতা ও প্রশাসন চালনার কর্ম শেষে তিনি অবসর গ্রহণ করেন । এক সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে নানা প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করে সিংহ রাশির জাতক আবদুল হকের কেটেছে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময়। ১৯৮৪ সালের ১৭ই ডিসেম্বর মিত্র বরণ করেন সূত্রেঃ পলি মাটির দেশ ভোলা, ভোলা জেলার ইতিহাস ।