মোঃ রায়হান জোমাদ্দার,স্টাফ রিপোর্টারঃ ঋতুর রাণী শরতের সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ কাশফুল। আর কাশফুলের অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়।শরতের মেঘহীন নীল আকাশে গুচ্ছ সাদা মেঘের ভেলা কেড়ে নেয়, প্রকৃতি প্রেমীদের মন। আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা আর তার নিচে কাশফুলের নাচানাচি অজান্তেই মানুষের মনে নির্মল আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। তবে আকাশে ধবধবে সাদা মেঘের শতদল আর মাটিতে মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া কাশফুল যে চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ছড়ায় তাতে থাকে শুধুই মুগ্ধতা। তবে কালের আবর্তে শরতকালের সেই চিরচেনা দৃশ্য এখন আর তেমনটি চোখে পরে না।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ কাশবন কেটে কৃষি জমি সম্প্রসারণসহ আবাসিক এলাকা গড়ে তুলছে। এতে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিকে অপরূপ শোভা দানকারী কাশফুল। সাহিত্যে কাশফুলের কথা এসেছে নানা ভাবে। রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন গ্রন্থ ‘কুশজাতক’ কাহিনী অবলম্বন করে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন। কাশফুল মনের কালিমা দূর করে, শুভ্রতা অর্থে ভয় দূর করে শান্তির বার্তা বয়ে আনে। শুভ কাজে কাশফুলের পাতা বা ফুল ব্যবহার করা হয়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সুব্রত কুমার দাস বলেন, কাশফুল এক ধরনের ঘাস জাতীয় জলজ উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Saccharum spontaneum. এরা উচ্চতায় দিই মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। নদীর তীরে জন্মানো শ্বেত শুভ্র কাশবন দেখতে খুবই সুন্দর। বাংলাদেশের ঋতুরীতি অনুযায়ী শরতের শোভা কাশফুল। তিনি বলেন,এ ফুল ফুটতে দেখেই বোঝা যায় এটা শরতকাল। কাশফুল মূলত ছন গোত্রীয় এক ধরনের ঘাস। নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো রুক্ষ এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু ঢিবিতে কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। তবে নদীর তীরেই এদের বেশি জন্মাতে দেখা যায়। এর কারণ হল নদীর তীরে পলিমাটির আস্তর থাকে এবং এই মাটিতে কাশের মূল সহজে সম্প্রসারিত হতে পারে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই কাশফুল দেখতে পাওয়া যায়। কাশফুল পালকের মতো নরম এবং ধবদবে সাদা। গাছটির চিরল পাতার দুই পাশ খুবই ধারালো।
তিনি আরও বলেন, কাশফুলের বেশ কিছু ওষুধি গুণ রয়েছে।যেমন-পিত্তথলিতে পাথর হলে নিয়মিত গাছের মূলসহ অন্যান্য উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি করে পান করলে পিত্তথলির পাথর দূর হয়। কাশমূল বেটে চন্দনের মতো নিয়মিত গায়ে মাখলে দুর্গন্ধ দূর হয়। কাশফুলের অন্য একটি প্রজাতির নাম কুশ। এরা দেখতে প্রায় কাশফুলের মতোই। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘পুরাণ’-এ কুশের স্থান খুব উঁচুতে। চর্ম জাতীয় রোগের চিকিৎসায়ও কাশফুল বেশ উপকারী বলেও তিনি জানান।
প্রকৃতির অপরূপ এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা প্রকৃতি প্রেমীরা জানান, নীল আকাশের নীচে সাদা কাশবন প্রকৃতিকে সাজিয়ে তুলেছে অপরূপ ভাবে। মনকে প্রফুল্ল রাখতে জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝেও শরৎ আসলেই নীল-সাদার এই অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে বারবার মন ছুটে আসি কাশবনে। শরতের কাশফুল নিয়ে কবিতা, গান, গল্পের শেষ নেই।
কবি শাহনাজ রুবির ভাষায়, এই মধুরিমা গোধুলী আমায় দাওনা! তোমার অপরূপ শ্যামশ্রী অনির্বাচনীয়, আমার উদাসী মনে ধূলি মলিন বিবর্ণতার অবসান হয়েছে, দাঁড়িয়েছি কাশবনে। আমিতো তাকিয়ে দেখি বিচিত্র পুষ্প বিকাশের লগ্নকালের পথ চেয়ে, কখন ফুটবে তোমরা বন বনানীর স্নেহময় ছায়ায়, চাতকের মতো দীর্ঘ তৃষ্ণায় নিবৃত্তি হবেনা। আমিতো বঙ্গ প্রকৃতিতে হৃদয়ের দ্বার খুলে বসে আছি, আমি এক বাংলার মেয়ে বলছি, ফুটে যাও, ফুটে যাও। সজল দিগন্তের ভেসে চলা বলাকার সারিরা আমায় বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়, নীল এবার ঘরে ফিরে যাও। ঘরে ফিরে যাও, সন্ধ্যা রানী এলো বুঝি ঘনিয়ে, এবার ফিরে চলো। বরিশাল নগরীর শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত স্টেডিয়াম এর কাছে এবং ত্রিশ গোডাউন এবং দোয়ারিকা ও খয়রাবাদ সেতুর ঢালে ও সদর উপজেলা চরবাড়িয়ার ইউনিয়নের তালতলী ব্রিজ এর ঢালে দিগন্ত জুড়ে ফুটে আছে সারি সারি শুভ্র কাশফুল। চোখে পড়বে এই দৃশ্য। করোনার প্রকোপ কাটিয়ে চিত্ত বিনোদনের জন্য কাশফুলের সাথে মিতালী করতে যান তারা। সেলফি আর পরিবার-স্বজন নিয়ে ছবি তুলে তারা মনের খোরাক যোগান। শরৎ কালে কাশফুল ঘিরে পর্যটকদের আনাগোনা হয় এসব স্থানে শরতের এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেখানে ভিড় করেন বরিশাল ও এর নিকটবর্তী এলাকার অসংখ্য মানুষ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষের কাছে এ কাশবন যেন একরাশ আনন্দ আর সাময়িক মুক্তির বার্তা।এখানে তাকালেই দেখা যাবে নীল আকাশের নিচে বাতাসে দোল খায় সাদা কাশফুল। সেই কাশবন যেন হয়ে উঠেছে শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো ছবি! তাই তো অনেকেই ছুটছেন সেখানে বিনোদন পেতে। নতুন এ বিনোদন স্পটে দর্শনার্থীরা কাশফুলের সাথে মিলেমিশে একাকার হচ্ছেন। ক্যামেরা বা মুঠোফোনে ছবি তোলায় মেতে ওঠেন। আবার অনেক শর্ট ফিল্ম প্রযোজকরা আসেন শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করতে। শরতের এ সময়টাতে সাদা আর সবুজের সাথে একাত্ম হয়ে ছুটে বেড়ায় কোমলমতি শিশু থেকে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও বৃদ্ধরা। শরতের বিকেলে রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি উপেক্ষা করে যান্ত্রিক পরিবেশকে পেছনে ফেলে প্রকৃতির কাছ থেকে একটু প্রশান্তি পেতে প্রায়ই কাশবনে ছুটে আসেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। এখানকার কাশবন যে কারো মনকে উদ্বেলিত করে।
বরিশাল সদর উপজেলা চরবাড়িয়ার ইউনিয়ন তালতলীর ব্রিজ এর কীর্তনখোলা নদীর তীর সংলগ্ন এ কাশবনের ভেতরে ঢুকলেই চারদিকে কাশফুল, নদীর ধারে শরীর-মন জুড়িয়ে দেওয়া বাতাস। তাই দুপুরের তীব্র রোদ উপেক্ষা করে কাশবনে বসে কেউ গল্প করছেন। আবার কেউ নিজের ছবি তুলছেন। আর পড়ন্ত বিকেলের কথা তো বলেই শেষ করা যায় না। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়।