মাহমুদা মাসুম
শিক্ষা মনুষ্যত্ব বিকাশের মাধ্যম ও জীবন সমস্যা সমাধানের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মননশীলতার উন্মেষ ঘটে। যার মূল ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশে শিক্ষা মূলত শিক্ষক-শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পরিচালিত হয়ে থাকে। আধুনিককালে শিখন- শেখানো কার্যক্রমে শুধু বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করলে হয় না। মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় কতগুলো বিষয়ে দক্ষতা ও কৌশল অবলম্বন করতে হয়, যা সামগ্রিকভাবে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বর্তমান সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে এ রকম একটি সংশ্লিষ্ট ও প্রাসঙ্গিক বিষয় হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি।
আজ পৃথিবী গ্লোবাল ভিলেজ বলে গণ্য। প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার আমাদের পৃথিবীকে গ্লোবাল ফ্যামিলিতে পরিণত করেছে। মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ইন্টারনেট উদ্ভাবন মানবসভ্যতাকে পৌঁছে দিয়েছে ভিন্ন এক উচ্চতায়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে। প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার ডিজিটাল বাংলাদেশ আন্দোলনের এক অন্যতম ক্ষেত্র বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রাথমিক শিক্ষার সফল সংযোজন ঘটানো হয়েছে। আমাদের শিক্ষার নানা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের শিক্ষাকে টেকসই ও মানসম্মত পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সহায়তা করেছে। ই-বুক প্রণয়ন, শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে পাঠ উপস্থাপন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যুগোপযোগী ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করছে। প্রাথমিকশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে বিশ্বায়নের যুগে উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে তথ্য-প্রযুক্তির সংযোগ ঘটানো হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে কাজে লাগানোর মাধ্যমে কঠিন শ্রেণি কার্যক্রমকে আনন্দময় করে তোলা হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, পঠনদক্ষতা উন্নয়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো, প্রমিত উচ্চারণ শেখা, পড়ার আগ্রহ তৈরিতে আইসিটি কার্যক্রম ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে শিশুরা খুশিমনে শেখে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহারের মাধ্যমে গতানুগতিক শিক্ষককেন্দ্রিক শিক্ষা কার্যক্রমকে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক আনন্দময় শিক্ষায় রূপান্তর করা হয়েছে।
২০১৩ সালের একটি ইমপ্যাক্ট স্টাডির ফলাফলে দেখা যায়, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, সেখানে শিক্ষার্থীদের মুখস্থবিদ্যার প্রবণতা কমেছে এবং শেখার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। শিক্ষকরা ইন্টারনেট সার্চ করে বিভিন্ন শিখন-শেখানো উপকরণ ডাউনলোড করে বিষয় ও শ্রেণি উপযোগী কনটেন্ট তৈরি করে ক্লাস নিতে পারছেন। এতে শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা ও জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক প্রতিটি ক্লাস পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাল হাজিরার প্রবর্তন শুরু হয়েছে।
বর্তমান যুগ ডিজিটাল যুগ। ডিজিটাইজেশনের এই যুগে শুধু বক্তৃতা পদ্ধতি অনুসরণ না করে ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে মাল্টিমিডিয়া দ্বারা পাঠদান করা হলে পাঠের শিখনফল অর্জন সহজ ও অধিকতর স্থায়ী হয়। বিভিন্ন শিখন-শেখানো পদ্ধতির মধ্যে প্রদর্শনপদ্ধতি একটি অত্যন্ত যুগোপযোগী ও কার্যকর শিক্ষণপদ্ধতি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল ক্লাসরুম স্থাপন করে ডিজিটাল কনটেন্ট উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা মূলত এই প্রদর্শনপদ্ধতিরই নামান্তর। এখানে শিক্ষার্থীরা দেখে ও শোনে এবং সহজভাবে আনন্দের সঙ্গে পাঠের বিষয়বস্তু আত্মস্থ করতে পারে। এতে তাদের এই শিখন স্থায়ী হয় এবং তারা বাস্তব জীবনে তা সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারে। ডিজিটাল কনটেন্ট উপস্থাপন করে প্রদর্শনপদ্ধতিতে পাঠদান অনেকাংশে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার প্রবণতা থেকে বিরত রাখে। মুখস্থ করার প্রবণতা শিক্ষার্থীর উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। এই মুখস্থ করার প্রবণতাকে আমরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল কনটেন্ট উপস্থাপন করে আত্মস্থ করার ধারণা দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারি।
ডিজিটাল কনটেন্ট হচ্ছে পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত বিষয়ের শব্দ ও ছবিতে তৈরি অডিও ভিজ্যুয়াল উপকরণ। অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রগ্রামের সহায়তায় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে শিক্ষকদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও মাইক্রোসফট পাওয়ার পয়েন্ট ব্যবহার করে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) ২০১৮ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল ক্লাসরুম তৈরিতে সরকার এরই মধ্যে দেশের প্রায় ৬৫ হাজার বিদ্যালয়ের ৫৩ হাজার ৬৮৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি করে ল্যাপটপ এবং ২২ হাজারের বেশি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর বিতরণ করেছে। এর পাশাপাশি নতুন করে ৩৬ হাজার ৭৪৬টি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর এবং ৫১ হাজার সাউন্ড সিস্টেম কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর বিতরণের মাধ্যমে ডিজিটাল ক্লাসরুম স্থাপনের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এ লক্ষ্যে যেসব বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ নেই, সেখানে সংযোগ স্থাপনের কাজ চলছে।
এ ছাড়া শিক্ষকদের আইসিটি ব্যবহার করে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য দেশের প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলোয় (পিটিআই) ১২ দিনব্যাপী আইসিটিবিষয়ক মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজারের বেশি বিদ্যালয় শিক্ষককে এই মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে পুরনো ৫৫টি ও নতুন ১১টি পিটিআইয়ে অত্যাধুনিক আইসিটি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, প্রাথমিকের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ২১টি বইয়ের ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহারের নিমিত্তে প্রাথমিক
শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ডিজিটাল কনটেন্টের ডিভিডি পাঠানো হয়েছে।
এখন আগের মতো দীর্ঘ সময়ব্যাপী পাঠ পকিল্পনা প্রণয়ন ও উপকরণ তৈরির বাড়তি চাপ না থাকায় শিক্ষকরা স্বাচ্ছন্দ্যে নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারছেন। এতে যোগ্যতাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা আগের তুলনায় অনেকাংশে ফলপ্রসূ হয়েছে। সরকার শিক্ষকদের ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরিতে যেমন প্রশিক্ষণ প্রদান করছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির বিষয়ে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। সেদিন আর বেশি দূরে নেই, যেদিন প্রত্যেক শিক্ষার্থী ছাপানো বইয়ের পরিবর্তে ই-বুক রিডারে বই পড়বে। আমাদের শিক্ষার্থীদের একবিংশ শতকের দক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানের এই প্রত্যাশা পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সত্যিকার অর্থে শিক্ষার প্রধান
শক্তিশালী হাতিয়ার আইসিটি।
( লেখক: মাহমুদা মাসুম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সদর উপজেলা লালমনিরহাট)