স্বপন কুমার রায়,খুলনা ব্যুরো প্রধানঃ বছরজুড়ে নিত্যপণ্যের দামে স্বস্তি ছিল না মানুষের। চাল, ডাল, তেল, আটা, চিনিসহ বেড়েছে প্রায় সব পণ্যের দাম। ভোজ্য তেল ও চিনিতে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও তার প্রভাব পড়েনি বাজারে। বাজারমূল্যের চেয়ে কিছুটা কম দামে পাওয়ায় ওএমএস ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য পেতে মরিয়া হয়ে ছুটেছেন সাধারণ মানুষ। তবে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও খালি হাতে ফিরেছেন অনেকে। ডিমের দামও সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙেছে। মূল্যস্ফীতি হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। অর্থাৎ পুরো বছর নিত্যপণ্যের দাম ভুগিয়েছে সাধারণ মানুষকে।
আটার দাম বেড়েছে দ্বিগুণ :বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে আটার দাম। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির বাজারমূল্য ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা।আর এক বছরে দাম বাড়তে বাড়তে সে দর দাঁড়িয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরে ৭০ শতাংশেরও বেশি দাম বেড়েছে পণ্যটির। এ ছাড়া খোলা আটার দাম বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। এক বছর আগে যেখানে খোলা আটার দাম সর্বোচ্চ ৩৮ টাকা ছিল এখন সেই আটার দাম বেড়ে ৬৫ টাকা হয়েছে। ফলে, আটা কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে ক্রেতাদের। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলারের বাজারের অস্থিতিশীলতা আটার বাজারকে অস্থির করে তুলেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কেজিতে ১০-১২ টাকা বেড়েছে চালের দাম :গত বছর ঠিক এ সময় ৪৬-৪৮ টাকার মধ্যে যেকোনো জাতের মোটা চাল কেনা যেতো। এখন সেটা ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৫৬-৫৮ টাকা। কোথাও কোথাও ৬০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে সরু চালের দাম (মিনিকেট) ৬০ টাকার মধ্যে ছিল, যা এখন ৭০-৭৫ টাকা। ভালো মানের নাজিরশাইলের দাম ৮০ টাকায় ঠেকেছে। একই ধরনের তথ্য দিচ্ছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সংস্থাটি বলছে, চালের দাম বছরের ব্যবধানে বেড়েছে মানভেদে ৬ থেকে ৮ শতাংশ। যদিও চাল উৎপাদনের সরকারি তথ্য বলছে, টানা কয়েক বছর দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি চাল উৎপাদন হচ্ছে। গত অর্থবছর (২০২১-২২) দেশে চালের উৎপাদন ছিল তিন কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টন। চলতি মৌসুমেও উৎপাদন হচ্ছে এর কাছাকাছি। সে অনুযায়ী দেশে বছরে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা।
তেল-চিনি নিয়ে অস্বস্তি সারা বছর :এ বছর তেল ও চিনির দাম সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙেছে। আবার বিভিন্ন সময় দাম বাড়ানোর জন্য সরবরাহ বন্ধ রেখে সংকট তৈরি করেছে কোম্পানিগুলো। সরকারও বারবার দাম বেঁধে দিয়েছে, কিন্তু বেশির ভাগ সময় সেটা কার্যকর হয়নি। টিসিবি বলছে, বাজারে সয়াবিন তেলের দাম এখন গত বছরের তুলনায় সাড়ে ২২ শতাংশ বেশি। আর চিনির দাম বেড়েছে সাড়ে ৪৫ শতাংশ। গত বছর এক কেজি চিনির দাম ৭৫ টাকার মধ্যে থাকলেও সেটি এখন ১১৫ টাকা। এদিকে বছরজুড়ে বারবার তেল-চিনির দর বাড়িয়েছে পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো। তবে নির্ধারিত দর সরকার অনুমোদন দিয়েছে কিনা সেটা নিয়ে সব সময় অস্পষ্টতা ছিল। কিন্তু দাম বাড়ানো নিয়ে মন্ত্রণালয়ের নীরব থাকার মধ্যে তেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো নিজেরাই দাম বাড়িয়ে বিভিন্ন দামে বিক্রি করেছে সারা বছর। সরকার থেকে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হলেও সেই দামে বিক্রি করতে গড়িমসি করেছে ব্যবসায়ীরা। তবে দাম বাড়লে পরের দিন থেকেই সেটি কার্যকর হয়ে গিয়েছে।
ভুগিয়েছে ডাল-ছোলা :আটা-ময়দা, তেল-চিনির মতো আরেক আমদানিনির্ভর পণ্য ডালের বাজারও শেষ সময় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নভেম্বর থেকে বাজারে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের ডালের দাম। খুচরা বাজারে বিভিন্ন ধরনের ডালের দাম বছর ব্যবধানে ২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে। টিসিবি’র হিসাবে, এক বছরের ব্যবধানে বড়, মাঝারি ও ছোট দানার মসুর ডালের দাম প্রতি কেজি যথাক্রমে ১৫, ২৪ ও ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এখন প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম মানভেদে ১০০ থেকে ১৪০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৯৭ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে। বাজারে খোলা মসুর ডালের পাশাপাশি সুপারশপ বা বড় দোকানে প্যাকেটজাত ডাল পাওয়া যায়। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত মসুর ডাল ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ১২০ টাকার মধ্যে ছিল। অন্যদিকে বছর ব্যবধানে ছোলার দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে এখন হয়েছে ৮০-৯০ টাকা, যা গত বছর ৬৫-৭০ টাকার মধ্যে ছিল।
ময়দার দাম বেড়েছে ৫০-৫৩ শতাংশ :২০২১ সালের ডিসেম্বরে ময়দার বাজার মূল্য ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। আর এক বছরে দাম বাড়তে বাড়তে সে দর দাঁড়িয়েছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরে ৫২ শতাংশেরও বেশি দাম বেড়েছে পণ্যটির। এ ছাড়া খোলা ময়দার দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এক বছর আগে যেখানে খোলা ময়দার দাম সর্বোচ্চ ৫০ টাকা ছিল এখন সেই ময়দার দাম বেড়ে ৭২ টাকা হয়েছে।
স্বস্তি ছিল না মাছ-মাংসের দামেও :ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত বছরব্যাপী চড়া ছিল গরুর মাংসের দাম। এক বছরের ব্যবধানে একশো-দেড়শো টাকা বেড়েছে। সঙ্গে চড়া ছিল সব মাছের দামও। বছরের মাঝামাঝি এসে অন্য মাছের মতো সবচেয়ে কম দামি মাছ পাঙ্গাশের দামও বেড়েছে। চাষের পাঙ্গাশ এখন ১৮০ টাকা, দর বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩০ টাকার মতো। তেলাপিয়া ১৮০ টাকায় পাওয়া যেতো, সেটা এখন ২২০ টাকা। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাছের দাম বছর ব্যবধানে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়তি।
মরিচ, আদা ও জিরার দামও আকাশ ছুঁয়েছে :
গত এক বছরে দেশি শুকনো মরিচের দাম কেজিতে বেড়েছে ১২০ শতাংশের মতো। আর আমদানি করা শুকনো মরিচের দাম কেজিতে বেড়েছে ৭২ শতাংশ। গত বছরের এই সময়ে দেশি আদার দাম ছিল ১০০ টাকা কেজি। এখন সেই আদা ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ২২০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার এই দেশি আদার দাম বেড়েছে ৯১ শতাংশ। আর ৭০ টাকা কেজি দরের আমদানি করা আদার দাম বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা। টিসিবি’র হিসেবে গত এক বছরে এই পণ্যটির দাম বেড়েছে ৮৪ শতাংশ। ৩৫০-৪০০ টাকা কেজি দরের জিরা এখন দাম বেড়ে হয়েছে ৬০০ টাকা কেজি।