সাইফুর রহমান শামীম,কুড়িগ্রামঃ কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত দুধকুমার ও ফুলকুমার নদীর কোল ঘেঁষে জেগে উঠা এক গ্রামের নাম ফান্দেরচর। বন্যা,খড়া,নদী ভাঙ্গনসহ নানা প্রকৃতির সাথে লড়াই করে চলে এ চরের মানুষগুলো।
সড়ক পথ না থাকায় প্রতিনিয়ত নানান বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের। এখানকার একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নৌকা। চরটির অবস্থান জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জ ইউনিয়নের চর পুর্ব দামালগ্রামে।
প্রায় ১০ বছর আগে জেগে ওঠা এই চরে বসতি স্থাপন করে প্রায় ২শ পরিবার। তাদের অধিকাংশই নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে বিভিন্ন চর থেকে উঠে আসা।
আধুনিক সভ্যতার এ যুগে যাতায়াত,বিদ্যুৎ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত চরবাসী । কৃষি, গবাদি পশু পালন,ও নদীতে মাছ ধরাই চরবাসীর আয়ের উৎস। অপরদিকে নদী ভাঙনে বাপ- দাদার ভিটেমাটি হারিয়ে এক চর থেকে আর এক চরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হচ্ছে তাদের। এ অবস্থায় শিক্ষা তো দুরের কথা জীবন জীবিকার প্রয়োজনে বৈরী প্রকৃতির সাথে লড়াই করে চলতে হয় প্রতিনিয়ত।
চরটিতে প্রাথমিক শিক্ষার কোন সুযোগ না থাকায় ঝরে পড়ছে অসংখ্য শিশু। এসব শিশুরা পরিবারের সাথে কৃষি কাজ, দিন মজুরী, মাছ ধরা, ও গবাদিপশুর রাখাল হয়ে বেড়ে উঠছে । এদের অনেকেই জেলার বাইরে গিয়ে শ্রম বিক্রি করে সংসারে যোগান দেয়। অভিভাবকগণের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছেলে- মেয়েদের চরের বাইরে রেখে পড়ালেখা করানোর সমর্থ্য নেই।
ফলে সন্তানদের শিক্ষিত করার স্বপ্ন -দুঃস্বপ্নই থেকে যায়।
নদ নদী বেষ্টিত এই চরের চার দিকে ৩/৪ কিলোমিটারের মধ্যে কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এ চরের ৯০ ভাগ মানুষই নিরক্ষর। এখানে বাল্য বিবাহের প্রবণতা বেশি।
এই চরের শিক্ষিত দম্পতি সহিদুল ইসলাম ও স্বপ্না শাপলা আক্তার সপ্না । সহিদুল টাঙ্গাইলের করটিয়া সাদত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স সহ মাস্টার্স করেছেন। আর শাপলা আক্তার স্বপ্না কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়ছে।
শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এসব ঝড়ে পড়া শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়াতে এগিয়ে আসে এই দম্পতি।
২০২২ সালের ২২আগস্ট চরের পরিত্যক্ত একটি মক্তব ঘরে ৩/৪ জনকে নিয়ে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। নাম দেয়া হয় ফান্দেরচর বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। পরবর্তীতে এই শিক্ষা কেন্দ্রের নাম পরিবর্তিত হয় “” শাপলার পাঠশালা””
পাঠশালাটিতে বর্তমান নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা শতাধিক। শিক্ষার্থীদের বয়স ৫ থেকে ১৪ বছর।
৪০ ফুট লম্বা দো-চালা টিনের ঘরটি শ্রেনীকক্ষ। নেই কোন আসবাবপএ। ঘরটিতে ২টি দরজা থাকলেও নেই জানালা।
নদী ভাঙ্গনের শিকার পাঠশালাটি ২ মাস আগে পশ্চিম ফান্দেরচর থেকে পূর্ব ফান্দের চরে স্থানান্তরিত হয়েছে।
মেঝেতে পলিথীন,মাদুর ও ছেড়াফাঁটা জুটম্যাট বিছিয়ে চলে শ্রেণি কক্ষের কার্যক্রম। ৩ সারি করে বসে ছাত্র-ছাত্রীরা পাঠদানে অংশ নেয় । পালাক্রমের শ্রনী শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন সহিদুল ও শাপলা।
প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলাম অনুযায়ী ১ম থেকে ৩য় শ্রনী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলে। শিক্ষা কেন্দ্রে নিয়মিত উপস্থিতি, পতাকা উত্তোলন, প্রাত্যহিক জাতীয় সংগীত পরিবেশন, আদব-কায়দা, শৃঙ্খলা বোধ,খেলাধুলা সব কিছুই চলে নিয়মানুযায়ী।
২০২২ ও ২০২৩ ইং শিক্ষাবর্ষে নাগেশ্বরী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে নতুন পাঠ্যপুস্তক সংগ্রহ করে এই দম্পতি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই পাঠশালা দেখতে আসেন ফান্দের চরে। উপহার দেয় শিক্ষার্থীদের স্কুল ব্যাগ,বই,খাতা, কল ও পেন্সিল।
শিক্ষার সুযোগ পেয়ে দারুন উচ্চশিত শিশুরা। স্বপ্ন দেখছেন সমাজের আর ১০ জনের মতো পড়াশুনা করে নিজকে আলোকিত করার।
শিক্ষার্থী লাবনী খাতুন (১০) সাদিকা আক্তার ( ৯), আরজিনা আক্তার (১৪), ও হেনা খাতুন ( ১৩) জানায়,তারা এর আগে কখনো স্কুলে যায়নি। সুয়োগ হয়নি লেখাপড়া করার। এর আগে পারিবারিক কাজে মাকে সহযোগিতা করতো। তারা এখন ব্যস্ত পড়ালেখা নিয়ে। লেখাপড়া শিখে তারা আলোকিত মানুষ হবার স্বপ্ন দেখছে। নাজমুল ইসলাম (১৪), রুবেল হোসেন ( ১৪) ,মেরাজ হোসেন ( ৯) ও আবু রায়হান (১৪) সহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, তারা এর আগে মাঠে কৃষি কাজ করে পরিবারকে সহযোগিতা করতো। কখনো স্কুলে যাবার সুযোগ হয়নি। স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ কি সেটাও জানতো না তারা। এখন পড়তে ও লিখতেও শিখেছে তারা। শিশুরা সকলেই সহিদুল -শাপলা দম্পতির শিক্ষা কেন্দ্রে পড়তে যায়। মাঠে কাজ করতে হয়না এখন তাদের।
শিশুদের অবিভাবক রাজিয়া বেগম ( ৪৫), গোলবানু ( ৩৬) ও আবদুর বহিম (৫০) জানান, চরে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায়, ছেলে মেয়েদের কে বাধ্য হয়ে সংসারের কাজে লাগিয়েছি। এখন তারা সহিদুল -শাপলার স্কুলে যায়।
ফান্দের চরের প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক ও উদ্যোক্তা সহিদুল ইসলাম জানান,তিনি অনেক কষ্ট করো চরের বাইরে গিয়ে পড়াশুনা করেছেন। চরের শিশুরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে -এ বিষয়ে কি তাকে দারুন ভাবে কষ্ট দেয়। বিয়ের পর বিষয়টি স্ত্রী শাপলাকে জানালে সেও রাজি হয়। শুরু হয় শিক্ষার আলো ছড়ানোর কার্যক্রম।
সহিদুল ইসলামের স্ত্রী স্বপ্না আক্তার শাপলা জানান,স্বামীর সাহসিকতায় অনুপ্রাণিত হয়ে,দুজন মিলে চরের অবহেলিত ও শিক্ষা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাদান করছি। প্রত্যাশা করেন এখানকার শিশুরা লেখাপড়া শিখে নিরক্ষতার গ্লানি দূর করবে। দূর হবে চরাঞ্চলের অন্ধকার।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শহিদুল ইসলাম জানান, সরকারি হাজার প্রকল্পের নীতিমালার আলোকে এ সকল চরাঞ্চলে জেগে উঠা ঘনবসতীর জন্য বিশেষ বিবেচনায় বিদ্যালয় নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।