রাজশাহী থেকে ইউসুফ চৌধুরী:
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বেকার যুবদের দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সম্পৃক্ত করে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে কাজ করছে। দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৮ থেকে ৩৫ বছরের যুবদের আবাসিক ও অনাবাসিক এবং স্বল্প মেয়াদি (ভ্রাম্যমাণ) বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তাদের কর্মস্পৃহা ও কর্মোদ্দীপনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও তাদের বিভিন্ন উৎপাদনমুখী গৃহীত প্রকল্পের মাধ্যমে হচ্ছে কর্মসংস্থান। প্রশিক্ষণ পরবর্তী সহজ শর্তে যুবঋণ নিয়ে স্ব-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সততা ও দক্ষতার সাথে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ বাস্ববায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন রাজশাহীর পবা উপজেলার যুব উন্নয়ন দপ্তরের দাযিত্বরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগন। সোনার বাংলা বিনির্মাণে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে তাঁরা সবাই সরকারের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ডের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িত। তাদের দক্ষ নেতৃত্বে আর্থিক ঋণ সহযোগিতা ও পরামর্শে প্রকল্প গ্রহনের মাধ্যমে যুবরা দেখছে আলোর মুখ। এর নেপথ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে সহযোগিতা করছে যুব উন্নয়ন দপ্তর। বিষয়টি পাখির চোখে না দেখলে ঠিক বোঝা যাবেনা।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু সালেহ্ মোহাম্মদ হাসনাত বলেন, “সুখি ও সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে জনগনের সেবক হিসেবে দ্রুত সময়ে সরকারি সেবাসমুহু জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতেই কাজ করছি। উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে উপজেলা প্রশাসনের প্রতিটি দপ্তর কাজ করছে। উদ্যোক্তাদের সরকারিভাবে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। চাকরির পিছনে না ছুটে প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হতে হবে। প্রকল্প গ্রহনের মাধ্যমে নিজের ও অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে সহযোগিতা করতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হবে উন্নয়নশীল বাংলাদেশ থেকে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ।”
উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা এমএমএন জহুরুল ইসলাম বলেন, “যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর দেশের যুবসমাজকে দক্ষ করে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ গ্রহন এবং আর্থিক ঋণ সহযোগিতার মাধ্যমে যুব উদ্যোক্তাদের গার্মেন্টস পণ্য উৎপাদন, হাঁস-মুরগি পালন, গরু মোটাতাজাকরণ, গাভী পালন, মৎস্য খামার, বুটিক হাউজ, বিউটি পার্লার, আইসিটি ও আউটসোর্সিং সহ মূলধন সৃষ্টির পাশাপাশি নিজের ও অন্যদের ভাগ্যের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। যুব সংগঠনের মাধ্যমে মাদক, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং ও যৌতুক প্রতিরোধ, সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা, শিক্ষা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম, পরিবেশ উন্নয়ন, সম্পদ সংরক্ষণ, প্রাকুতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সহ বিভিন্ন জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে যুবরা।”
মৎস্য চাষে সফল উদ্যোক্তা সেলিম! পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের কুখন্ডি গ্রামের ইসলাম আলীর ছেলে সেলিম হোসেন। তরুন উদ্যোক্তা পেশায় একজন মৎস্য চাষী, খামারী ও ব্যবসায়ী। ২০২২ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগী ও গবাদিপশু পালনে পশু চিকিৎসক হিসেবে তিন মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। মুরগী পালন দিয়ে শুরু হয় যাত্রা। সফলতা পেতে শুরু হলে বাড়াতে থাকে একের পর এক প্রকল্প। তিনি আজ সফল উদ্যোক্তা। এইসব কাজে সৃষ্টি হয়েছে নিজের ও অন্যদের কর্মসংস্থান। তার খামারে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন পঞ্চাশজন নারী পুরুষ।
সেলিম হোসেন বলেন, “যুব উন্নয়ন থেকে সহজশর্তে ষাট হাজার ঋণ ও নিজস্ব অর্থ দিয়ে খামার ও পাঁচ’শ মুরগী পালন শুরু করি। লাভের মুখ দেখায় খামার ও মুরগীর পরিমান বৃদ্ধি করি। এখন ছয়টি খামারে প্রায় দশ হাজার লেয়ার মুরগী আছে। প্রতিদিন ছয় হাজার ডিম পায়। এর পাশাপাশি পুকুর লীজ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করি। প্রায় দুই’শ বিঘার উপর বারোটি পুকুর লীজ নেওয়া আছে। গরু মোটাতাজাকরণের জন্য আছে দুইটি গরু। পুকুর পাড়ে পেয়ারা, কলা সহ বিভিন্ন মৌসুমী আবাদ করি। পাশাপাশি একটি দোকান আছে, সেখান বিক্রয় করি হাঁস-মুরগী, গবাদিপশুর খাদ্য সামগ্রী ও কৃষির বিভিন্ন উপকরণ।”
বুটিক হস্তশিল্পের কাজে সফল উদ্যোক্তা বেবী নাজমিন! পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার বালিয়াডাঙ্গা মহল্লার নজরুল ইসলামের মেয়ে বেবী নাজমিন খাতুন। স্বামীর নিজের বাড়ী না থাকায় বিয়ের পর থেকে বাবার বাড়ীতে থাকেন। স্বামীর আয় কম হওয়ায় সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকত। চিন্তা করে স্বামীর আয়ের পাশাপাশি কিছু একটা করার। যে কথা সেই কাজ। যুব উন্নয়ন থেকে ২০১৫ সালে হস্তশিল্প বুটিক এর প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। প্রথমে অন্যের কাজ দিয়ে যাত্রা করলেও পরে নিজেই বুটিক হস্তশিল্পের কাজ শুরু করেন। এলাকার পঞ্চাশজন নারী কর্মীকে বুটিক হস্তশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করেছেন। তারা এখানে কাজ করে তৈরি করছেন বিছানার চাদর, কুশন, কভার, কটি, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, টুপিস, থ্রিপিস, শাড়ি, ওড়না ও নকশি কাঁথা সহ বিভিন্ন ডিজাইনের বুটিক পন্য। আর ঘরে বসেই নারীরা সংসারের কাজের পাশাপাশি কাপড়ের উপর রঙিন সুতা-সুই এর ফোঁড়ে এসব পণ্য তৈরি করছেন। কাজে সফলতা পেয়ে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
বেবী নাজমিন বলেন, “স্বামীর কাজের আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হতো। যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৫ সালে সংসারে বাড়তি উপার্জনের আশায় বুটিক হস্তশিল্পের কাজ শুরু করি। প্রথমে কয়েকজনকে নিয়ে হস্তশিল্পের পণ্য তৈরি শুরু করি। গড়ে তুলি ‘হ্যাপি বুটিক হাউস’। বুটিক পন্য বিক্রয় করে লাভের মুখ দেখি। আমার সংসারের উন্নতি হয়েছে। এখন গ্রামের অসহায় কর্মহীন নারীদের জন্য কিছু করতে চেষ্টা করছি। এখানে পঞ্চাশজন নারী কাজ করে। তাদের সংসারও এখন স্বচ্ছল।”
মুরগীর খামারে কাজে ব্যস্ত নারী উদ্যোক্তা হাসিবা বেগম! পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের দহপাড়া গ্রামের রবিউল ইসলাম এর স্ত্রী হাসিবা বেগম। স্বামী, ছেলে ও মেয়েসহ চারজনের সংসার। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে শুরু হয় অভাব অনটন। একার আয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। নিজের চাষযোগ্য কোন জমি ছিল না। যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুরগীর খামার শুরু করলে আর পিছনে ফিরতে হয়নি। স্বামী স্ত্রী মিলে খামার দেখাশনা করেন।
হাসিবা বেগম বলেন, “সংসারে খুব অভাব চিন্তা করি স্বামীর পাশাপাশি কিছু করার প্রয়োজন তখন উপজেলা যুব উন্নয়নের মাধ্যমে হাঁস-মুরগী ও গরু মোটাতাজাকরণের প্রশিক্ষণ গ্রহন করি। এরপর যুব উন্নয়ন থেকে সহজশর্তে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খামার ও তিনশ’টি লেয়ার মুরগী পালন শুরু করি। এভাবে যুব উন্নয়নের আর্থিক ঋণ সহযোগিতায় মুরগী পালনের পরিমান বৃদ্ধি করি। সেখানে এখন সাত’শ পঞ্চাশটি লেয়ার মুরগী ও এক’শটি হাঁস আছে। প্রতিদিন গড়ে সাত’শ ডিম পায়। বাবার দেওয়া একটি গাভী ও একটি গাভী কিনে পালন শুরু করি। এখন গাভীসহ দশটি গরু আছে। পাঁচটি গাভীর পেটে বাচ্চা আছে। প্রতিদিন গড়ে একটি গাভী থেকে দশ কেজি দুধ পায়। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে। এখন প্রায় পনেরো লক্ষ টাকার সম্পদ আছে।”
গরুর খামারে সফল তরুণ উদ্যোক্তা নুর ইসলাম! পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বামনশিকড় গ্রামের শাহজাহান আলীর ছেলে নুর ইসলাম। স্ত্রী সন্তানসহ পাঁচজনের সংসার তার। বিয়ের পর সংসারে অভাব অনটন শুরু হলে দিশেহারা হয়ে পড়েন। স্ত্রী ও পরিবারের সাথে পরামর্শ করে ২০১৭ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে মৎস্য চাষ ও গরু মোটাতাজাকরণের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
নুর ইসলাম বলেন, “কোন কাজ কর্ম নাই বেকার হয়ে পড়ি সংসারে অভাব শুরু হয়। প্রশিক্ষণ গ্রহনের পর যুব উন্নয়ন থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পয়ত্রিশ হাজার টাকায় গাভী গরু ক্রয় এবং বাকী পনেরো হাজার টাকা নিয়ে মাছের ব্যবসা শুরু করি। সেই গাভী গরু থেকে বাচ্চা হয়। এখন চারটি গাভী পালন ও দুইটি গরু মোটাতাজাকরণ করছি। দুইটির পেটে বাচ্চা আছে। দুইটি গাভী থেকে প্রতিদিন বিশ লিটার দুধ হয়। আমি ও আমার স্ত্রী মিলে গরুর দেখভাল করি। প্রতি বছর ঈদের সময় গরু বিক্রয় করে এবং মাছের ব্যবসায় ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে লাভের মুখ দেখি।”
যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষণ ও যুবঋণ সহযোগিতায় বদলেছে তাদের জীবন। কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ পরিবর্তন হয়েছে আর্থ-সামাজিক অবস্থার। হয়েছে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। তবে অনেক উদ্যোক্তা দাবী করেছেন আর্থিক ঋণ সহযোগিতার পরিমান খুব কম। সহজশর্তে স্বল্পসুদে আর্থিক ঋণ সহযোগিতার পরিমান বৃদ্ধি হলে ব্যবসা বড়সহ স্বাছন্দে কাজ করতে পারবে বলে আশাবাদী উদ্যোক্তারা।