ড. খান আসাদুজ্জামান পিভিএমএস:
প্রতি বছর বর্ষা আসলেই বন্যায় দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলের মানুষের ভোগান্তির হাহাকার ও প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার চিত্র চোখে পড়ে। যদিও আমাদের দেশের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সাথে লড়াই করেই বেঁচে আছে। তাইতো এবার স্মরণকালের ভয়াবহতম ও নজিরবিহীন বন্যার কবলে দেশের পূর্ব সীমান্তবর্তী জেলা।
পাহাড়ি ঢল ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মৌসুমি লঘুচাপ ও ভারি বৃষ্টিপাতে সুরমা-কুশিয়ারা, ধলাই, মনু, খোয়াই, পূর্বাঞ্চলের গোমতী, মুহুরী ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ফেনী, হালদা নদীগুলোর পানি বেড়ে দেশের ১২ জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেটে পরিস্থিতি বেশি অবনতি হয়েছে। অন্যান্য জেলায়ও ধীরে ধীরে বন্যার অবনতি ঘটছে।
তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে বন্যায় প্রাণহানী ও জনদুর্ভোগের সীমা ছাড়িয়েছে। অনেক মানুষ হতাহত হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে মহাসড়ক থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনপদের হাঁটা রাস্তা পর্যন্ত প্রায় সব সড়কের। ক্ষতি হয়েছে বিদ্যালয়, হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ দোকানপাট ও বসতবাড়ির। ফসলের ক্ষতি হয়েছে হিসেবে ছাড়া। অজস্র পানের বরজ নষ্ট হয়েছে। পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। খাদ্যাভাব ও অসুখবিসুখে অনেক মানুষ দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। চারিদিকে পানিতে থৈ থৈ। কতো মা-বাবা অসহায় হয়ে সন্তানকে পানিতে ভাসিয়েছে হাতড়াতে হাতড়াতে বাঁচানোর জন্য কতো চেষ্টা। বানের জলের সাথে চোখের জলে একাকার। বৃষ্টি সাথে উজানের পানি হু হু করে বাড়েছে। কোনটা গ্রাম, কোনটা শহর কিংবা কোনটা নদী বুঝে ওঠা ছিল দুষ্কর, মনে হয় এ যেন এক বেদনার নীল সাগর। কবরের জায়টুকু অবশিষ্ট ছিল না। সব কেড়ে নিয়েছে সর্বনাশা পানিতে। ধনী-গরিব সবাইকে এককাতারে নামিয়ে এনেছে প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে। কী মর্মান্তিক নিদারুণ করুণ দৃশ্য দেখে চোখে পানি ধরে রাখা সম্ভব না। পরিস্থিতি এমন যে, পর্যাপ্ত নৌযান ও অন্যান্য উদ্ধার যানের অভাবে পানিবন্দি এসব মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া কঠিন ছিল। ভয়াল বন্যার তাণ্ডবে বানভাসি মানুষকে উদ্ধার ও খাদ্যদ্রব্য সরবরাহে কাজ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড এবং সেই সঙ্গে যোগ দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সাধারণ মানুষ। মানবিক মানুষও আসছে দুর্গতদের পাশে, আগে থেকে মানবিক মানুষ হিসেবে পরিচিত অনেকে এবারও দাঁড়িয়েছেন বন্যাদুর্গতদের পাশে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তারা সংগ্রহ করছেন তহবিল। সেই অর্থ দিয়ে দিচ্ছেন তারা ত্রাণ। কেউ নৌকা নিয়ে, কেউ ওষুধ নিয়ে, কেউ ত্রাণ নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আবার কেউ মানবিক সংগঠনকে বড় অঙ্কের অনুদান দিয়ে সহায়তা করছেন।
এগিয়ে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীও, যা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই ছাত্রজনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘স্বৈরশাসকের’ পতন ঘটিয়ে নতুন ইতিহাস গড়েছে তরুণ প্রজন্ম। যা দেশের ইতিহাসে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর এমন ছাত্র জনতার-জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে তীব্র আন্দোলন আর হয়নি। ঠিক যেমন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেমন এ দেশের কৃষক শ্রমিক আবাল বৃদ্ধ বণিক ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশকে স্বাধীন করেছিল। ঠিক তেমনি এই ভয়াবহ বন্যায় দেশের ছাত্রজনতার পাশাপাশি সম্মিলিতভাবে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ যেন সম্প্রীতির এক অনন্য বাংলাদেশ।