আসাদুজ্জামাল জামাল,ভালুকা প্রতিনিধিঃ ৮ ডিসেম্বর) ভালুকা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালে এই দিনে ময়মনসিংহের ভালুকাকে মেজর আফসার উদ্দিন আহম্মেদ এর নেতৃত্বে হানাদার মুক্ত হয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতার লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন। এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে মুক্তিযোদ্ধা সহ নানা পেশার মানুষ প্রতি বছর ৮ ডিম্বেবর “ভালুকা মুক্ত দিবস” হিসেবে উদযাপন করে আসছে। এবারও মুজিব শতবর্ষ , স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী ও আফসার বাহিনীর নেতৃত্বে ভালুকা মুক্ত দিবস উপলক্ষে ৮ ডিম্বেবর থেকে ১৬ ডিম্বেবর সপ্তাহ ব্যাপী ভালুকা উপজেলার পরিষদ চত্বরে “বিজয় মেলা”র আয়োজন করেছেন উদযাপন কমিটি।উদযাপন কমিটির আহবায়ক জাতীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কাজিম উদ্দিন আহম্মেদ ধনু বলেন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ই্তিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তোলে ধরতেই আমাদের এবার এ অয়োজন। আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাস,ভালুকার ই্তিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তোলে ধরা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের বিভিন্ন যুদ্ধে আব্দুল মান্নান এবং মরহুম আফসার উদ্দিন আহম্মেদের ছেলে নাজিম উদ্দিনসহ ৪৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন।
১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পাক বাহিনী ঢাকায় আক্রমণ করলে সে দিন থেকেই সারা বাংলাদেশে পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। গফরগাঁও, শ্রীপুর, ফুলবাড়িয়া, ত্রিশাল ও ভালুকা উত্তরাঞ্চলীয় প্রবেশদ্বার ৭১ রণাঙ্গনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল।
এর আগে ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ সোনার পর থেকে ভালুকা উপজেলার সর্বস্তরের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিচালনার জন্য দেশ প্রেমিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক ও নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের জনগণের উপস্থিতিতে ভালুকা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
ব্রিটিশ ভারত সেনাবাহিনী (অব:) সুবেদার তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আফসার উদ্দিন আহম্মেদ ১৯৭১ সালে তৎকালীন ভালুকা উপজেলার রাজৈ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ মেম্বারের কাছ থেকে একটি মাত্র রাইফেল ও ৮ জন সদস্য নিয়ে ভালুকা উপজেলার মল্লিকবাড়ি ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মল্লিকবাড়ি বাজারের খেলু ফকিরের বাড়িতে মুক্তি বাহিনীর একটি গেরিলা দল গঠন করেন।
এরপর ভালুকা থানা দখল করে ১৪ থেকে ১৫টি রাইফেল ও একটি এল, এম, জিসহ প্রচুর গোলাবারুদ সংগ্রহ করেন। এর কয়েক দিনের মাথায় কাউরাইদ হতে খীরু নদী ভালুকা থানায় আসার পথে ভালুকা উপজেলার রাজৈ ইউনিয়নের পনাশাইল এলাকায় পাকিস্তান পাক হানাদার বাহিনীর অস্ত্র ও গোলা-বারুদসহ একটি নৌকা আটক করে মুক্তিযোদ্ধারা। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে গেরিলা একটি দল শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হয়। প্রথমে আফসার উদ্দিনের নেতৃত্বে ৮ জন সদস্যের একটি দল গঠন করে। এরপর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নিয়ে গড়ে তোলে একটি বিশাল বাহিনী।
এফ জে ১১ নম্বর সেক্টরের ময়মনসিংহ জেলা দক্ষিণ ও ঢাকা জেলা উত্তর সাব-সেক্টর অধিনায়ক মেজর আফসার ব্যাটেলিয়ান নামে পরিচিত লাভ করে। যুদ্ধকালীন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য ডা. রমজান আলী তরফদার তত্ত্বাবধানে ৫ জন ডাক্তার, ১০ জন সহকারী ও ৪ জন নার্সর সমন্বয়ে আফসার ব্যাটালিয়ন হাসপাতাল নামে একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল পরিচালিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন রেডক্রস সংস্থার দ্বারা পরিচালিত হয়।
১৯৭১ সালে শুক্রবার (২৫ জুন) সকাল হতে ভালুকা টু গফরগাঁও সড়কের ভাওলিয়াবাজু এলাকায় শিমুলিয়া নদীর পাড়ে পাকিস্তানের পাক বাহিনীর সঙ্গে আফসার বাহিনী সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দিবারাত্রি দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা একটানা যুদ্ধ স্থায়ী হয়। শুক্রবার শুরু হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাক বাহিনী চারিদিকে পানি বেষ্টিত নদীর পূর্ব পাড়ে গোয়ারী যোগীপাড়া এলাকায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। শুক্রবার সারাদিন ও সারারাত তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে অনেক পাক সেনা নিহত হয়।
পরদিন শনিবার (২৬ জুন) সকাল ১১টার দিকে ঢাকা হতে আকাশ পথে আসা পাক হানাদার বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ করে ভারি মেশিন গানের সেলিং শুরু করে। এসময় মুক্তিযোদ্ধারাও হেলিকপ্টার লক্ষ করে পাল্টা ব্রিটিশ এল এম জির সাহায্যে গোলা বর্ষণ অব্যাহত রাখলে হেলিকপ্টার পিছু হটে।
এরপর শনিবার সন্ধ্যায় দিকে যুদ্ধক্ষেত্রের ৪ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে ধলিয়া গ্রামে ধলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হেলিকপ্টার থেকে পাক সেনা নামিয়ে দিলে মুক্তিযোদ্ধারা ডিফেন্স ছেড়ে চলে আসে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা নদীর পশ্চিম দিকে একটানা দুইদিন সম্মুখ যুদ্ধ করায় পাক সেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধে আফসার বাহিনীর তরুণ যোদ্ধা ভালুকা উপজেলার মল্লিকবাড়ি ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মল্লিকবাড়ি বাজারের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আব্দুল মান্নানের মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। এ সময় মজিবর রহমানসহ আরও পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়।
১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক ওই যুদ্ধের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল-ইন্ডিয়া রেডিও ও বিবিসি হতে ফলাও করে সম্প্রচার করা হয়। ওই যুদ্ধের পর ভালুকা থানা ও বাজার এলাকায় পাক বাহিনীর ক্যাম্পটি শক্তিশালী করা হয়। স্থানীয় মুসলিমলীগ নেতারা এখানে গড়ে তোলেন একটি বিশাল রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প। ভালুকা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন, গ্রাম ও পাড়া-মহল্লায় দিনের পর দিন মানুষ হত্যা, নারী ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিকাণ্ড লুটপাট চালায় রাজাকার ও আলবদররা।
আফসার বাহিনী যুদ্ধকালীন বিভিন্ন সময় একাধিক বার ভালুকায় পাক হানাদার ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়েছেন। এছাড়াও আমলীতলা যুদ্ধে, বল্লা যুদ্ধ, গফরগাঁও, শ্রীপুর, ফুলবাড়িয়া, ত্রিশাল, ভালুকা, মল্লিকবাড়ি ও মেদুয়ারীসহ বিভিন্ন এলাকায় রাজাকার ও পাক সেনাদের সঙ্গে আফসার বাহিনীর অসংখ্য যুদ্ধ করেছেন।