লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে বেশি জমিতে পাট চাষ হচ্ছে মেহেরপুর
মোঃ কামাল হোসেন খাঁন,মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধিঃ
জাতীয় ফসল গুলোর মধ্যে অন্যতম পাট। সোনালী আঁশ খ্যাত এই পাটের একসময় বিশ্ববাজারে ব্যাপক চাহিদা ছিল। কালের বিবর্তনে ভাবমূর্তি অনেকটাই ক্ষুন্ন হয়েছে এবং পাটের চাহিদা কমে গেছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে পাটের নিত্যনতুন ব্যবহার পাট দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি এর ফলে চাহিদা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। যদিও মেহেরপুরে পাটের চাহিদা নেই বললেই চলে।
তবুও পরিবেশ বান্ধব এই সোনালী আঁশ পাট চাষ মেহেরপুর জেলায় প্রচুর পরিমাণে হয়ে থাকে।
তাছাড়া সরকারের পাটজাত দ্রব্য ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, পাটের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি হিসেবে পাটের খড়িকে ব্যবহার এবং পাট চাষে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে জেলার কৃষকরা পাট চাষ করে থাকেন।
চলতি মৌসুমে মেহেরপুরের ৩টি উপজেলা জুড়ে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২১ হাজার ৪৩৩ হেক্টর জমিতে। তবে লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে আরও বেশি জমিতে পাটের চাষ হয়েছে।
মেহেরপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাসরিন পারভীন জানান, উপজেলায় পাট চাষের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে কিন্তু চাষ হয়েছে ৫ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে।
গাংনী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লাভলী খাতুন জানান, চাষের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১২ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে কিন্তু চাষ হয়েছে ১২ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে।
মুজিবনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান খান জানান, উপজেলায় পাট চাষের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে কিন্তু চাষ হয় ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে।
মেহেরপুরের প্রতিটা এলাকার রাস্তার দু’পাশসহ দু’চোখ যতদূর যায়, শুধু পাট আর পাট। সোনালী আঁশ পাট গাছের সবুজ সমারোহ, দুলছে বাতাসে। এ এক অসম্ভব ভালো লাগা। যেটি উপভোগ করা যায়, মাইলমারীর রাস্তা হয়ে ধলার মাঠে যেতে। বিশাল মাঠ জুড়ে পাট ছাড়া নজরে আর কিছুই মেলেনা। যা কোমর ছাড়িয়ে মাথা ছুঁই ছুঁই।
তারপরও পাট চাষে আশানুরূপ ফলন থেকে বঞ্চিত হবেন বলে ধারণা করছেন অনেক কৃষক। তাদের অনেকেই জানান, ভারতীয় জাতের পাটের বীজ স্থানীয় দোকান বা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে তা বপন করার পর পাট গাছ না গজানোর কারণে ২য় বার নতুন করে আবারও বীজ বপনে তারা অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। অসাধু দোকানীদের ভারতীয় বীজ বিক্রিতে এভাবেই পিছিয়ে পড়লেন তারা। এরপর থেকেই ঘনঘন বৃষ্টিতে পাটের গাছ লালচে বর্ণ কিংবা ছোট ও চিকন হয়ে রয়েছে, কোন কোন জমির পাটের গোড়ায় শিকড় গজিয়েছে। তাছাড়া সময়মতো নিড়ানি না দিতে পারায় তা স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠা থেকে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
জেলার বেশ কয়েকজন পাট চাষির সাথে আলাপকালে তারা জানান, আসলে পাট চাষ লাভজনক তবে কৃষকরা তেমন একটা লাভবান হচ্ছেন না। এর কারণ হচ্ছে পাটের জমিতে নিড়ানি, জমি থেকে পাট কাটা, গাড়িতে জলাশয়ে নেওয়া, পানিতে ডুবানো, আঁশ ছড়ানোসহ সবকিছুর মূল্য বৃদ্ধি।
মাইলমারী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ জানান, পাটের চাষ করে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যে খরচ হয় তাতে করে পাটের খড়ি ছাড়া তেমন একটা লাভবান হওয়া যায় না।
হরিরামপুর গ্রামের আব্দুস সালাম জানান, পাট চাষ লাভজনক কিন্তু বর্তমান সময়ে লেবার মূল্য অত্যাধিক বেশি হওয়ায় লাভের মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা।
পশ্চিম মালশাদহের আব্দুল কাদের জানান, নিজেরা পরিশ্রম করলে লাভ। তাছাড়া লেবার দিয়ে কাজ করাতে তাদের মজুরি দেওয়ার পর পাটখড়ি ছাড়া আর কিছুই থাকবেনা।
মাইলমারী গ্রামের রুস্তম আলী জানান, পাট চাষ লাভজনক না হলেও বাড়িতে রান্নার কাজে চুলা জ্বালাতে পাটখড়ি ছাড়া অসম্ভব। তাছাড়া পাটখড়ির মূল্য কোন অংশে কম না। পানের বরজ আর তামাক চাষিরা চওড়া মূল্যে পাটখড়ি কিনে থাকেন।
মাইলমারী বিশ্বাস ট্রেডার্স এর স্বত্ত্বাধিকার ইসাহক আলী জানান, পাটের মূল্য কম কিসের, বিগত সময়ে ৭/৮’শ টাকা মন বিক্রি হলেও এখন ভালো মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। তবে মজুরি খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপত্তি সৃষ্টি হচ্ছে।
লক্ষ্ণিনারায়ণপুরের মাহবুবুর রহমান জানান, পূর্বে পাটের মূল্য কম থাকলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাটের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভেজা পাট রপ্তানি করায় পাট ক্রয়ে আগ্রহ হারিয়েছেন শহরের ব্যবসায়ীরা।
কাজীপুর মুন্সি নগরের ফুলচাঁদ আলী জানান, পাট চাষ লাভজনক। তবে পাট কাটার পর জাগ দেওয়ার জন্য পানি পাওয়া কঠিন। অনাবৃষ্টির কারণে খাদ খন্দকে পানি না থাকায় শ্যালো ইঞ্জিন চালিত মেশিনে পানি দিয়ে পাট জাগ দিতে হয়।
মাইলমারী গ্রামের কইন উদ্দিন বিশ্বাস জানান, ৪ বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। এপর্যন্ত ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। পাট বিক্রি করে হয়তো খরচটুকুই উঠবে। তবে তামাক পুড়াতে পাটখড়ির চাহিদা পূরণেই তিনি পাট চাষের কথা জানালেন।
হাড়াভাঙ্গা গ্রামের ইউসুফ আলী জানান, বীজ, সার, লাঙ্গল, সেচ, কীটনাশক, পাটকাটা, বয়ে জমি থেকে জলাশয়ে নেওয়া, জলাশয়ে ডুবানো, আঁশ তোলা, সব মিলিয়ে ব্যাপক খরচ, হিসাব করলে প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ১৫ হাজার। পাট বিক্রি করে সেই ১৫ হাজার টাকায় হবে। তবে লাভ হবে পাটের খড়ি। যা বিক্রি করে হতে পারে আরও ৫ হাজার।
তবে প্রায় সকল পাট চাষিদের দাবি, পাটের মূল্য আরও বৃদ্ধি করা হোক। যাতে করে পাট চাষিরা শুধু পাটখড়ি না আর্থিক দিক থেকেও যেন লাভের মুখ দেখতে পারে। অন্যথায় পাটচাষে কৃষকরা আগ্রহ হারাতে পারে বলে তিনারা অভিমত ব্যক্ত করেন।