কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ একুশে পদকপ্রাপ্ত অ্যাডভোকেট এস এম আব্রাহাম লিংকন স্বর্ণ পদক ও পদকের সঙ্গে প্রাপ্ত ৪ লাখ টাকা এবং ব্যক্তিগত এক লাখ টাকাসহ পাঁচ লাখ টাকা নিজের প্রতিষ্ঠিত উত্তরবঙ্গ জাদুঘরে দান করেছেন। সোমবার দুপুরে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক ও উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ এর কাছে এই অর্থ ও পদক হস্তান্তর করেন তিনি। এ উপলক্ষে জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন পুলিশ সুপার আল আসাদ মোঃ মাহফুজুল ইসলাম , জাদুঘরের কো ফাউন্ডার ও ট্রাস্টের সেক্রেটারি অধ্যাপক নাজমুন নাহার সুইটি, সনাক সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু, সাবেক সিভিল সার্জন ডা. আমিনুল ইসলাম, কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক ফারুক, সাংবাদিক মমিনুল ইসলাম মঞ্জু, আওয়ামীলীগ নেতা মতি শিউলী, প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সাধারণ সম্পাদক আফতাব হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধ এবং সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক হারুন অর রশীদ লাল প্রমুখ।
আব্রাহাম লিংকন কুড়িগ্রাম শহরের নাজিরা এলাকায় নিজ বাড়িতে উত্তরবঙ্গ জাদুঘর গড়ে তুলে কয়েক হাজার মূল্যবান স্মারক সংগ্রহ করে প্রদর্শন করছেন। উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের নতুন ভবনের জন্য নিজস্ব জমি ট্রাস্টের নামে দান করেন। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বহুতল ভবন নির্মাণ চলমান রয়েছে।
তিনি ২০২২ তাঁর নানামুখী কাজের অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ একুশ পদকে ভূষিত হন। এছাড়া তিনি রাকসুর এজিএস, ফেলানী হত্যা মামলার সহযোগী আইনজীবী ছিলেন। তিনি কুড়িগ্রাম আইন মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, ছিটমহল আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। তিনি কুড়িগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির একাধিকবার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
একুশে পদকে ভূষিত এস এম আব্রাহাম লিংকন
এস এম আব্রাহাম লিংকন তাঁর বহুমাত্রিক কাজের জন্য দেশ ও দেশের বাইরে পরিচিত। ছাত্র জীবনে তুমুল জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন। ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের এজিএস এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। এ দুটি পদেই তিনি সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত হন। নব্বইয়ের ছাত্রগণঅভ্যূত্থানের পর কুড়িগ্রাম জেলায় থিতু হন। ঢাকায় সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী সমিতির সদস্য হলেও সেখানে পেশায় না জড়িয়ে কুড়িগ্রামেই থেকে যান। সেখানেই গড়ে তোলেন কুড়িগ্রাম আইন মহাবিদ্যালয়। যার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ তিনি। তিন দশকের অধিককাল তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। এ দায়িত্বকালে আজ অবধি তিনি বেতন ভাতা বা কোনো সম্মানি গ্রহণ করেন নি। তিনি অধূনালুপ্ত ছিটমহলের নাগরিকদের মুক্তির জন্য গড়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনের তিনি অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব। মুক্তির সে লড়াইয়ে তিনি বাংলাদেশ ও ভারত দু দেশের ছিটমহলের মানুষের সাথে লড়াইয়ে সামিল থেকেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর বিস্তর কাজ রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার কাজ করতে গিয়ে বহু দুর্লভ দলিলাদি উদ্ধার করেন। যোগাড় করেন বহু স্মারক। যেগুলো জাতীয় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষ্যও বটে। তিনি সংগৃহিত নানা স্মারক দিয়ে নিজের বশতগৃহে তোলেন একটি সংগ্রহশালা। যা আজ উত্তরবঙ্গ জাদুঘর নামে দেশ-দেশ-বিদেশে পরিচিত। এই জাদুঘর দর্শনে কুড়িগ্রামে আসেন বিপুল সংখ্যক পর্যটক। এখান থেকে দেশ বিদেশের গবেষকরা নানা তথ্য উপাত্ত নিয়ে নানারুপ গবেষণার কাজ করছেন। এই জাদুঘরের দলিলাদি মানবতা বিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিচারকার্যেও ব্যবহার হচ্ছে। আব্রাহাম লিংকন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সীমান্ত প্রতিষ্ঠায় বহুবছর ধরে কাজ করছেন। দু দেশের নাগরিক যারা সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও মাসের পর মাস বছরের পর বছরবিভিন্ন কারাগারে আটক আটক আছেন তাদের স্ব স্ব দেশে ফেরাতে (Repatriation) নিরবে কাজ করে যাচ্ছেন। ফেলানী হত্যার পর ভারতীয় বিএসএফের দায়ের করা মামলায় তিনি ফেলানীর বাবার পক্ষে তাদের আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণকালে বাংলাদেশের পক্ষে একাধিক বার প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি কুড়িগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির একাধিকবার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
তিনি উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের নতুন ভবনের জন্য তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক নাজমুন নাহার সুইটিসহ প্রয়োজনীয় জমি ট্রাস্টের নামে দান করেন। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বহুতল ভবন নির্মাণ চলমান রয়েছে।
আব্রাহাম লিংকন গত ২০২২ তাঁর নানামুখী কাজের অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ (সমাজসেবা) একুশ পদকেভূষিত হন। তিনি ২০২২ এর ২০ ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষরিত সনদ, সাড়ে তিন ভরির স্বর্ণের মেডেল এবং চার লক্ষ টাকার চেক প্রাপ্ত হন।
এ পদক প্রাপ্তির পর তিনি এটি বঙ্গবন্ধু , জাতীয় চার নেতাসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নামে উৎসর্গ করেন। একইসাথে ঘোষনা করেছিলেন প্রাপ্ত সোনার মেডেলটি উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের দর্শণার্থীদের প্রদর্শনের জন্য এবং প্রাপ্ত চার লক্ষ টাকার সাথে নিজের এক লক্ষ টাকা যোগ করে পাঁচ লক্ষ টাকা উত্তরবঙ্গ জাদুঘর এর স্থায়ী তহবিল গঠনের জন্য এককালীন দান করার। সে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আজ তিনি জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক ও উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ এর কাছে হস্তান্তর করেন। এসময় পুলিশ সুপার আল আসাদ মোঃ মাহফুজুল ইসলাম , জাদুঘরের কো ফাউন্ডার ও ট্রাস্টের সেক্রেটারি অধ্যাপক নাজমুন নাহার সুইটি, টিআইবি সনাক আহ্বায়ক এড. আহসান হাবিব নীলু, প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল খালেক ফারুক সহ বিপুল সংখ্যক নাগরিক উপস্থিত ছিলেন।