মারবার্গ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় ১১ জন মারা গেছেন। এই ভাইরাসে আক্রান্ত আরো ২৫ জনকে কোয়ারেন্টিনে রেখেছে দেশটি। অতিসংক্রামক এই ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইতোমধ্যে সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এক প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে প্রথম এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের কথা প্রকাশ করে রুয়ান্ডা। পরে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন এবং চিকিৎসার ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করা হবে।
মারবার্গ মূলত ইবোলা পরিবারের সদস্য, তবে এটি ইবোলার থেকেও মারাত্মক। এই ভাইরাসে ফলে রক্তক্ষরণজনিত জ্বর হতে পারে, যা রক্তনালীগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। মায়ো ক্লিনিকের মতে, রক্তক্ষরণজনিত এই জ্বর অভ্যন্তরীণ রক্তপাত ঘটায়, যা মৃত্যুর ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
১৯৬৭ সালে জার্মানির মারবার্গ শহরে ভাইরাসটি প্রথম সনাক্ত হয়। পরে এই ভাইরাসের নাম দেয়া হয় মারবার্গ ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, এই ভাইরাসে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার ২৪ থেকে ৮৮ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। ইতোপূর্বে ভাইরাসে সংক্রমিতদের মধ্যে গড়ে প্রায় অর্ধেক মানুষেরই মৃত্যু হয়েছে।
ডব্লিউএইচও বলছে, একজন ব্যক্তির ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার পরে দুই থেকে ২১ দিনের মধ্যে তারমধ্যে এর লক্ষণ দেখা যেতে পারে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) অনুসারে, মারবার্গ ভাইরাস আক্রান্তদের জ্বর, মাথাব্যথা, পেশী এবং জয়েন্টে ব্যথা, ক্লান্তি, ক্ষুধা কমে যাওয়া, রক্তপাত এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনালের মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
মারবার্গ ভাইরাস আক্রান্তদের জন্য রক্তপাত বেশ বিপদজনক। খারাপ রোগীর ক্ষেত্রে আক্রান্তের প্রায় পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে রক্তপাত শুরু হতে পারে। ডব্লিউএইচও-এর ওয়েবসাইট বলা হয়েছে, বমি বা মলের রক্তপাতের সঙ্গে প্রায়ই নাক, মাড়ি এবং মেয়েদের ভ্যাজাইনা থেকেও রক্তপাত হতে পারে। আর এসব লক্ষণ দেখা দেয়ার ৮/৯ দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটির কলেজ অফ পাবলিক হেলথের অধ্যাপক আমিরা রোয়েস আল জাজিরাকে বলেছেন, “যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারা এই ভাইরাস থেকে গুরুতর অসুস্থ হতে পারে। পাশাপাশি তাদের মৃত্যুঝুঁকিও অনেক বেশি।
মূলত রুসেটাস বাদুড়ের সংস্পর্শে আসার পরে কিছু লোক মারবার্গ ভাইরাসে সংক্রামিত হন। তবে রুয়ান্ডা বর্তমান প্রাদুর্ভাবের উৎস এখনও স্পষ্ট নয়। একবার একজন ব্যক্তি ভাইরাসে সংক্রামিত হলে, তার চামড়া বা শ্লেষ্মা ঝিল্লির মাধ্যমে শারীরিক তরলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে অন্যরাও এতে আক্রান্ত হতে পারে। ডব্লিউএইচওর ওয়েবসাইট বলছে, এমনকি বিছানার চাদর বা পোশাকের মতো জিনিস, যা আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক তরল দ্বারা দূষিত হলে তা থেকেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। তবে সিডিসির তথ্য অনুযায়ী, ভাইরাসটি বায়ুবাহিত নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকিকে “জাতীয় পর্যায়ে খুব বেশি, আঞ্চলিক পর্যায়ে উচ্চ এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে কম” হিসাবে মূল্যায়ন করেছে। তবে সমস্যা হলো ভাইরাসের জন্য কোনো অনুমোদিত ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা নেই। রুয়ান্ডার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাবিন নসানজিমানা বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছেন, তার দেশ এই ভাইরাস প্রতিরোধী একটি ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। আর ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল এইডস ভ্যাকসিন ইনিশিয়েটিভ (আইএভিআই) এবং সাবিন ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন কার্যক্রম রুয়ান্ডার সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করছে।
নিজেকে রক্ষা করবেন যেভাবে
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ আমিরা রোয়েসের মতে, মারবার্গ ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করতে স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন, অসুস্থ ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকতে হবে। পাশাপাশি ভাইরাসের উপসর্গ আছে এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শে একান্তই আসতে হলে মাক্স পরতে হবে। তবে সংক্রামিত হতে পারে এমন ব্যক্তির সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া যাবে না।
তার কথায়, “আপনি যদি মনে করেন যে আপনি ভাইরাসের আক্রান্ত, তাহলে অন্য ব্যক্তির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ সীমিত করুন। লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করে স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা কর্মী বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে রিপোর্ট করুন।”
বেশিরভাগ রোগের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী কতজন লোক ওই প্রাদুর্ভাবে সংক্রামিত হয়েছে তা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ থাকে না। তাই প্রতিরোধমূলক নজরদারি এবং অন্যান্য কর্মসূচিতে অর্থায়নের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের একসাথে কাজ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়গুলো যদি গুরুত্ব সহকারে না নেয়া হয়, তাহলে আরও মানুষ প্রাণ হারাবেন।