মোঃ খলিলুর রহমান, সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার চারটি সংসদীয় আসনে জোট মহাজোটের সাথে আসন সমঝোতায় প্রর্থীতা হারানোর শঙ্কা কাটলেও দলীয় হেভিওয়েট কয়েকজন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় স্বাচ্ছন্দে নেই আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা। এছাড়া বিএনপি-জামায়াতের অংশগ্রহণহীন নির্বাচনে সাতক্ষীরায় ভোটার উপস্থিতিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আবার ভোটার উপস্থিতি বেশি হলে আওয়ামী লীগ বিরোধীরা প্রতিপক্ষের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নৌকা হারানোয় ভূমিকা রাখতে পারে-এ আশঙ্কাও রয়েছে অনেকের মধ্যে। এমনই অবস্থায় নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন সাতক্ষীরায় একজন প্রবীন ও তিনজন নবীনসহ নৌকার মাঝি আওয়ামী লীগের চার প্রার্থী।
বিএনপি-জামায়াতহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অতীতের জয় পরাজয়ের হিসাব খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না হলেও জেলার রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া সূচিত হয়েছে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নে। চারজন প্রার্থীর মধ্যে তিনজনই অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং প্রথমবার দলীয় মনোনয়ন লাভ করেছেন। তবে দলের মধ্যে, এমনকি সাধারণ মানুষের কাছে এরা বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে তিনবারের সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা আ,ফ,ম ডাঃ রুহুল হক তো রয়েছেনই। কিন্তু জোট-মহাজোটের হিসাব-নিকাশ, দলের মধ্য হতে স্বতন্ত্র প্রার্থী, ভোটার উপস্থিতির বিষয়টি নানামুখি সংশয়ের সৃষ্টি করছে।
সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী ফিরোজ আহমেদ স্বপনের বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বি রয়েছেন আরো ১১জন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রার্থীরা হলেন, বর্তমান নৌকার সংসদ সদস্য ওয়ার্কার্স পার্টির এড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রবীন রাজনীতিবীদ সৈয়দ দিদার বখত।
আরো রয়েছেন, জাসদের জেলা সভাপতি শেখ ওবায়দুস সুলতান বাবলু, তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ নুরুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এসএম মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগের কর্মী মোঃ নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় মহাসচিব ইয়ারুল ইসলাম, জাকের পার্টির মোঃ খোরশেদ আলম, তৃণমূল বিএনপির সুমি ইসলাম এবং মুক্তিজোটের শেখ মোঃ আলমগীর।
সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলা পরিষদের দুইবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু। দলের ভিতরে বাইরে তার রয়েছে ক্লিন ইমেজ। কিন্তু এই আসনে আওয়ামী লীগের নৌকার ভোট তুলনামূলক কম। যেকারণে ৭৩ এর পর কোন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে এখানে নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেনি।
এই আসনে জাতীয় পার্টির দীর্ঘদিন বেশ শক্তিশালী অবস্থান ছিল। নবম জাতীয় সংসদে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এমএ জব্বার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। এছাড়া অতিতের নির্বাচনগুলোতেও জাতীয় পার্টি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পায়। এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। দশ বছর একটানা সংসদ সদস্য থাকায় সদর উপজেলার এলাকার চেয়ারম্যান মেম্বারসহ দলের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটির একটি অংশ তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ আফসার আলী, এনপিপির মোঃ আনোয়ার হোসেন, জাকের পার্টির শেখ ইফতেখার আল মামুন সুমন, ওয়ার্কার্স পার্টির মোঃ তৌহিদুর রহমান, বিএনএম-এর মোঃ কামরুজ্জামান বুলু, তৃণমূল বিএনপির মোস্তফা ফারহান মেহেদী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের এনছান বাহার বুলবুল রয়েছেন নির্বাচনী মাঠে।
সাতক্ষীরা-৩ (দেবহাটা-আশাশুনি-কালিগঞ্জ আংশিক) আসন পুনর্গঠনের পর নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা, সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত মুখ ডা. আ.ফ. ম. রুহুল হক। গত ১৫ বছরে তার নির্বাচনী এলাকায়, এমনকি সাতক্ষীরা জেলার উন্নয়নে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সাতক্ষীরার চারটি আসনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। এই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসাবে আছেন এড. স. ম. আলিফ হোসেন। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে তিনিও হয়ে উঠতে পারেন ডাঃ রুহুল হকের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বি। এছাড়াও রয়েছেন স্যাম্যবাদী দল (এমএল) এর পলিট ব্যুরো সদস্য শেখ তরিকুল ইসলাম, এনপিপির মোঃ আব্দুল হামিদ, জাকের পার্টির মোঃ মঞ্জুর হোসেন এবং তৃণমূল বিএনপির জাসদ নেতা রুবেল হোসেন।
সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর-কালিগঞ্জের আংশিক) আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও শ্যামনগর উপজেলা পরিষদের দুইবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান এসএম আতাউল হক দোলন। জেলায় রয়েছে তার ক্লিন ইমেজ। পিতা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একে ফজলুল হক সাবেক সাতক্ষীরা-৫ আসনের দুইবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য। পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে শ্যামনগর জুড়ে।
এ আসনে রয়েছেন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ মহাজোট থেকে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত সাবেক জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য এইচএম গোলাম রেজা। তিনি এবার বিএনএম থেকে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এলাকায় তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। রয়েছে জনপ্রিয়তা। দলবাজী, টেন্ডারবাজী, কমিশন খাওয়া, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বড় ধরনের কোন অভিযোগ নেই এই নেতার বিরুদ্ধে। এই আসনে জাতীয় পার্টির হয়ে লড়ছেন দুইবারের নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান মাহাবুবর রহমান। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের মাসুদা খানম, তৃণমূল বিএনপির আসলাম আল মেহেদী, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মোঃ শফিকুল ইসলাম, এনপিপির শেখ একরামুল ও স্বতন্ত্র মোঃ মিজানুর রহমান রয়েছেন।
এদিকে সাতক্ষীরার চারটি আসনের তিনটিতে নৌকার প্রার্থীরা রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। কারণ এই তিনটি আসনেই নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থীর পাশাপাশি রয়েছেন জাপা ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ বিএনএম থেকে মনোনয়ন প্রাপ্ত একজন সাবেক এমপি। ফলে স্বাচ্ছন্দে নেই আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা।
সবমিলিয়ে জেলার চারটি সংসদীয় আসনে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত না দেখে কেউ নিশ্চিত হতে পারছেন না আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কে জয়ী হবেন, কে হাসবেন শেষ হাসি।