মোঃ খলিলুর রহমান,সাতক্ষীরাঃ উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের জেলেপল্লীর সোনামনি দাসি (৬৫), বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সুন্দরবন সংলগ্ন দাতিনাখালী গ্রামের শেফালী বিবি (৫৫) কিংবা শ্যামনগর পৌরসভার হায়বাতপুর গ্রামের চন্দ্রিকা ব্যানার্জী (৫৫)। এরা সবাই পরিবারের প্রধান। উপকূলীয় এ এলাকার মাত্র এই ৩ জনই নয়, অনেক অসহায় নারী রয়েছেন যারা বেঁচে থাকার তাগিদে কাজ করছেন।
এদের মধ্যে কারও স্বামী সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের আক্রমণের শিকার হয়ে মারা গেছে, কারও স্বামী অসুখে মারা গেছেন, কারও স্বামী ফেলে চলে গেছেন, আবার কারও স্বামী দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত। সংসারের বোঝা নারীর কাঁধে। পরিবারে অভাব অনটন বারোমাস লেগেই রয়েছে। পরিবারের প্রধান দুস্থ-অভাবী নারীদের দুঃখ পিছু ছাড়ে না। এখানে ওখানে চেয়েচিন্তে খাওয়া, ধারকর্জ করে চলা, সাহায্যের জন্য সরকারি বেসরকারি সংস্থায় হাত বাড়ানো তাদের নিত্যসঙ্গী। তবুও জীবন ধারণে কখনো অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটে তাঁদের।
উপকূলের নারীদের-ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবনে অবহেলা, বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার নিত্যদিনের তবে নেই সমাধান। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে সংসারে নারী হয়ে ওঠেন পরিবারের প্রধান। অথচ কোথাও নেই এতটুকু স্বীকৃতি। উপরন্তু আছে যৌতুকের চাপ, তালাকের ভয়। স্বামীর একাধিক বিয়ে শেষ জীবনেও নারীকে দেয় না স্বস্তি। জীবনের রঙিন দিনগুলোর শুরুতেই বাল্যবিয়ের ভোগান্তি চাপে নারীর কাঁধেই। তবুও নারীকে সইতে হয় নানাবিধ গঞ্জনা। দুর্যোগ এলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি বাড়ে নারীর। লঙ্ঘিত হয় অধিকার। ভয়াল নদীতে মাছ ধরার মতো পেশায় দেখা মেলে উপকূলের নারীর। জীবিকার তাগিদে নদীতে গিয়ে স্বামী ফিরে না এলেও নারীকে নামতে হয় জীবন সংগ্রামে।
সোনামনি ষাটোর্ধ্ব এক সংগ্রামী নারী। থাকেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ বাজারের পেছনে জেলেপাড়ায়। একাকী জীবন। ছোটবেলায় সোনামনির বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনে মাছ শিকারে গেলে স্বামীকে প্রাণ দিতে হয় বাঘের আক্রমণে। একমাস বয়সী শিশুসহ স্বামীর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় শাশুড়ি। সমাজ সোনামনিকে ‘অপয়া’ বলে আখ্যা দেয়। যেন তার অপরাধের কারণে স্বামীকে বাঘে নিয়েছে। এভাবে দিন যেতে থাকে। কিছুদিন পরে দেবরের সঙ্গে বিয়ে হয় সোনামনির। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ২০০২ সালে দ্বিতীয় স্বামীও সুন্দরবনে মাছ শিকরে গেলে তাকে ও বাঘের আক্রমণে প্রাণ দিতে হয়। দুই স্বামী বাঘের পেটে যাওয়ার পর সোনামনি ‘স্বামীখেকো’ বলে পরিচিতি পায়।
সমাজ তাকে দেখে ভিন্ন চোখে। কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত করত না তাকে। সমাজে চলাফেরাই তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। সমাজ তাকে অপয়া, অলক্ষ্মী বলে আখ্যা দেয়। শাশুড়ি তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখেন, যাতে সকালে ঘুম থেকে উঠে সোনামনির মুখ দেখতে না হয়।
সোনামনির প্রথম স্বামীর একটি সন্তান ও দ্বিতীয় স্বামীর তিনটি সন্তান। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে মেয়েরা সবাই বিবাহিত এবং আলাদা আলাদা। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই মাকে ও তারা দেখে না।
বর্তমানে সংসার কিভাবে চলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার আর সংসার! আমি একলা! বাজারের দোকান ঝাড়ু দেই, গাঙে জাল টানি মাছ, কাঁকড়া ধরি, ঘেরে মাটি কাটার কাজ করি। যখন যে কাজ পাই তা করি। এভাবে চলতিছে।তবে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমি বিধবা তা তোমরা জানো কিন্তু আমাগে চেয়ারম্যান, মেম্বাররা তা জানে না।
চন্দ্রিকা ব্যানার্জীর (৫৫)। শ্যামনগর পৌরসভার হায়বাতপুর গ্রামের মৃত অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে। তাঁর পিতা অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন দক্ষিণ খুলনার বিশিষ্ট সেতার বাদক ও সংগীতশিল্পী। তাঁর তিন মেয়েয় মধ্যে চন্দ্রিকা ব্যানার্জী সবার বড়।
চন্দ্রিকা ব্যানার্জী উপকূলীয় এলাকার সুবিধাবঞ্চিত পিছিয়ে পড়া নারীদের একত্রিত করে তৈরি করেন নারী সংগঠন নকশীকাঁথা। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত নারী সংগঠন নকশীকাঁথার পরিচালক হিসেবে তিনি নিজস্ব কর্ম এলাকার নারীদের উন্নয়নে তথা এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যক্রম, কৃষি, হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ, সুপেয় পানির নিশ্চয়তা প্রদানে কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি ইতিপূর্বে জয়িতা পুরস্কার, সফল সংগঠক পুরস্কারসহ অন্যান্য সম্মাননা গ্রহণ করেছেন। তিনি উপজেলা সরকারি কৃষি কমিটি, ভূমি কমিটি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কমিটি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিটি, বেসরকারি পানি কমিটি, ভূমি কমিটি, জলবায়ু পরিষদ সদস্য, মহিলা ক্রীড়া সংস্থাসহ বিভিন্ন কমিটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তিনি গত কয়েক বছর আগে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের সহায়তায় ইউরোপ, সুইডেন, ডেনমার্কসহ কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করে বাংলাদেশের নারীদের সাফল্য বিভিন্ন সেমিনারে তুলে ধরেছেন।
চন্দ্রিকা ব্যানার্জী জানান, ১৯৯৪ সালে সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর থেকে সকল ক্ষেত্রে নারীদের অধিক মাত্রায় প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তায় সুপেয় পানি সংরক্ষণে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রযুক্তি, পুকুর ফিল্টার স্থাপন, ঝরে পড়া শিশুকে উপ-আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিশু শিক্ষা প্রদান, বয়স্ক শিক্ষা প্রদান, নারী প্রধান কৃষি পরিবারে লবণসহিষ্ণু ধানবীজ বিতরণ, পুষ্টির চাহিদা পূরণে নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে ক্লাব গঠন ও প্রশিক্ষণ, প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, হস্তশিল্প ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। নারী প্রধান ভূমিহীন পরিবারকে খাসজমি পেতে অস্থায়ী/স্থায়ী বন্দোবস্ত সহযোগিতাসহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছেন।
শেফালী বিবি (৫৫) সুন্দরবনঘেঁষা দাতিনাখালী গ্রামের ছবেদ আলী গাজী স্ত্রী। কেওড়ার টক-ঝাল-মিষ্টি আচার আর জেলি তৈরি করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। মোম দিয়ে শোপিসসহ বিভিন্ন পণ্য বানিয়েও বাজারজাত করেন তিনি। তিনি এখন অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারীদের দৃষ্টান্ত।
শেফালী শুধু নিজের ভাগ্যের চাকাই ঘুরাননি, সুন্দরবনের সুরক্ষা ও বনজীবীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য উপকূলীয় এলাকার বননির্ভর নারীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘দাতিনাখালী বনজীবী নারী উন্নয়ন সংগঠন’। শতাধিক নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে করেছেন আত্মনির্ভরশীল। প্রশিক্ষিত এসব নারীও কেওড়ার চকোলেট, আচার ও জেলি এবং সুন্দরবনের মধু বয়ামজাত করে বিক্রির মাধ্যমে উপার্জন করছেন অর্থ। এসব পণ্য বিক্রির লভ্যাংশ ব্যয় হচ্ছে ‘বাঘ বিধবা’ ও বনজীবী নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে।
শেফালী জানান, সুন্দরবনের কোলে চুনা নদীর পাড়ে এক টুকরো খাসজমিতে তাঁদের বাস। স্বামী ছবেদ আলী গাজী সুন্দরবন থেকে মোম, মধু, মাছ, কাঁকড়া ও গোলপাতা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন । কিন্তু তাতে পাঁচজনের সংসার ঠিকমতো চলত না।
তাই নিজেই কিছু করার কথা ভাবতে থাকেন। একপর্যায়ে উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বারসিকের পরামর্শে সুন্দরবনের ফল কেওড়ার টক, ঝাল ও মিষ্টি আচার, জেলি এবং চকোলেট তৈরি শুরু করেন। একই সঙ্গে মোম দিয়ে শোপিস, মোমবাতিসহ বিভিন্ন পণ্য বানিয়ে বিক্রি করতে থাকেন। এতে তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্যের মুখ দেখেন তিনি।
এবিষয়ে শ্যামনগর উপজেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মিসেস শাহানা হামিদ বলেন, উপকূলের নারীরা যেভাবে সংসারের হাল ধরছেন সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে নারীদের সরকারি সহায়তার মাধ্যমে এসব কাজে আরও উদ্যোগী করা প্রয়োজন। কারণ এরাই অর্থনীতি চাঙ্গা করার মূল হাতিয়ার। উপকূলে নারী জেলে শ্রমিক রয়েছেন এমন তথ্য সরকারের কাছে নেই। তাদের নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার।
উপকূলের নারীরা যেসব কাজে এগিয়ে, তা দেখতে হলে এখানে আসতে হবে। দেশের সামগ্রিক নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে এসব নারী অংশীদার। তাই সরকারের পক্ষ থেকে এসব নারীকে বিনা সুদে ঋণ সহায়তা দেওয়া উচিত।