ইয়াসির আরাফাত মিলনঃ বাংলাদেশ সরকার ক্রমাগত লোকসানের ভার বইতে না পেরে গত বছর থেকে দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৬টি চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করার পর মাথায় হাত পড়েছে এসব চিনিকলের ওপর নির্ভরশীল আখ চাষিদের। চিনিকল বন্ধ থাকায় অধিকাংশ কৃষক আখের আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও পাবনার অনেক কৃষক আশায় বুক বেঁধে আখের আবাদ করে এখন তাদের উৎপাদিত আখ মিলে সরবরাহ করা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
মিল বন্ধ থাকায় এ বছর পাবনা চিনিকল এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত আখ সরবরাহের দায়িত্ব নেবে না বলে জানিয়েছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। পাবনার নিকটবর্তী গোপালপুর চিনিকলে গত বছর কৃষকরা আখ সরবরাহ করতে পারলেও এ বছর এখনও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাননি চাষিরা, এ কারণে অনেকেই এখন দুশ্চিন্তায় আছেন।
পাবনা চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফ উদ্দিন জাতীয় দৈনিক আলোচিত কণ্ঠ কে বলেন, ‘পাবনা চিনিকলের অন্তর্গত ১০টি চিনি উৎপাদনের জোন আছে। তবে উৎপাদন কম হওয়ায় এ বছর মিলের নিকটবর্তী ৪টি আখ উৎপাদন জোনকে পাবনার নিকটবর্তী গোপালপুর চিনিকলের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ফলে কৃষকদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।’
যে ৪টি জোন নাটোরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে সেগুলো হলো, ঈশ্বরদী জোন, মুলাডুলি জোন, লক্ষ্মীকুণ্ডা জোন ও মিলগেট জোন। এসব জোনের আওতাধীন কৃষকরা নির্ধারিত সময়ে আখ সরবরাহ করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
পাবনা সুগার মিলের আখচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনসার আলী দিলু জাতীয় দৈনিক আলোচিত কণ্ঠ কে জানান, তিনি গত বছর আটঘরিয়া উপজেলায় তার ২৫ বিঘা জমিতে আখের আবাদ করে মিল বন্ধ ঘোষণা দেওয়ার পর উৎপাদিত আখ নিয়ে অনেক কষ্টে নাটোরের গোপালপুর চিনিকলে সরবরাহ করতে পেরেছিলেন। তবে এ বছর এখনও মিল কর্তৃপক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত না জানানোয় দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।
অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে পাবনা সুগার মিলের শতাধিক কোটি টাকার সম্পদ।
গত বছর ২৫ বিঘা জমিতে আখের আবাদ করলেও আনসার আলী এ বছর মাত্র ১৫ বিঘা জমিতে আখ আবাদ করেছেন, বাকি জমি অন্য কৃষকদের কাছে লিজ দিয়েছেন। এ কারণে এ বছর তিনি লোকসানে পরেছেন বলে জানান।
এক বিঘা জমিতে আখের আবাদ করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব হলেও মিল বন্ধ থাকায় মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার চুক্তিতে জমি লিজ দিতে হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আনসার আলী আরও জানান, আখের ফলন ভালো হলেও সময়মত আখ সরবরাহ করতে না পারলে তাকে পথে বসতে হবে।
পাবনা চিনিকল জোনের ক্ষুদ্র চাষি আফসার আলী জানান, গত বছর ৩ বিঘা জমিতে আখের আবাদ করলেও মিল থেকে এ বছর কৃষকদের জন্য সার, বীজ, কীটনাশক ও নগদ অর্থ সহায়তা না দেওয়ায় ধার-দেনা করে আঁখের আবাদ না করে সবজির আবাদ করেছেন তিনি। অর্থকরী ফসলের চাষি হওয়ায় পরও পাবনা সুগার মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন সাধারণ সবজি চাষি হয়ে গেছেন বলে জানান।
পাবনা চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফ উদ্দিন জানান, গত বছর থেকে দেশের ৬টি সুগার মিল বন্ধ ঘোষণা করায় চিনিকল থেকে কৃষকদের ক্রেডিট দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। চিনির উৎপাদন বন্ধ থাকায় কৃষকদের কাছ থেকে রিটার্ন না পাওয়ায় ক্রেডিট সরবরাহ বন্ধ রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি জানান, চিনিকল বন্ধ থাকায় চিনিকল এলাকায় আখের উৎপাদনও হ্রাস পেয়েছে।
গত বছর শিল্প মন্ত্রণালয়ের ১১৬ নম্বর স্মারকের এক চিঠিতে বলা হয়, চিনি আহরণের হার, আখের জমি, মিলের অবস্থা, লোকসানের পরিমাণ এবং ব্যবস্থাপনার খরচ বিবেচনা করে দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৬টি চিনিকলে আখ মাড়াই না করতে প্রস্তাব করা হলো। অধিকতর বিবেচনায় ৯টি চিনিকলে আখ মাড়াইয়ের সুপারিশ করা হয়েছে।
মিলের যন্ত্রপাতিতে মরিচা ধরে সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে পাবনা চিনিকলসহ দেশের ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ রাখার আদেশ জারি হওয়ায় ২০২০ সাল থেকে পাবনা চিনিকল, কুষ্টিয়া চিনিকল, রংপুর চিনিকল, পঞ্চগড় চিনিকল, শ্যামপুর চিনিকল, সেতাবগঞ্জ চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গত মৌসুম থেকে পাবনা চিনিকলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে পাবনা সুগার মিলের শতাধিক কোটি টাকার সম্পদ। পরিচর্যার অভাবে মিলের পুরো এলাকা আগাছায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে, আগাছা জন্মেছে মিলের ইয়ার্ডে অযত্নে পড়ে থাকা প্রায় ২ শতাধিক ট্রলিতে। মিলের যন্ত্রপাতিতে মরিচা ধরে সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
দ্রুত মিল চালু করা না গেলে মিলের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন মিলের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও কৃষকরা। কৃষকদের স্বার্থে মিলের উৎপাদন পুনরায় চালু করার দাবি করেন তারা।
পাবনা সুগার মিলের আখচাষি সমিতির সভাপতি শাজাহান আলী বাদশা জাতীয় দৈনিক আলোচিত কণ্ঠ কে বলেন, ‘কৃষকদের স্বার্থে দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল আখের উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য বন্ধ মিল চালু করা দরকার। অচিরেই বন্ধ মিল চালু করা না হলে এসব মিলের সঙ্গে জড়িত কৃষকরা দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল আখের উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।’
পাশাপাশি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকায় বন্ধ মিলের শত শত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে সরকার আরও লোকসানে পড়বে বলেও জানান তিনি।
পাবনা সুগার মিল কর্তৃপক্ষ জানায়, মিলের উৎপাদন বন্ধ রাখা হলেও মিলটি এখনও পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করা হয়নি। মিলের আধুনিকায়ন করে পুনরায় উৎপাদন শুরু করার পরিকল্পনা করছে সরকার।