জাতীয় সারাদেশে

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যেন মৃর্ত্যুর ফাঁদ, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন

বার্তকক্ষ: আলোচিতকণ্ঠ:

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় তিন দুর্ঘটনায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়; আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। শুধু জাঙ্গালিয়া এলাকা নয়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে প্রায় প্রতিদিন ঘটছে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা।
এ মহাসড়ক যেন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। গত দুই মাসে ছোট-বড় প্রায় শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপ্রশস্ত সড়ক, লবণ পানিতে মহাসড়ক পিচ্ছিল থাকা, অদক্ষ চালক, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক বাঁক, ওভারটেকিং, মহাসড়কে নিষিদ্ধ ছোট যানবাহন চলাচল, ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চলাচল ও সড়কের দুইপাশে উঁচু-নিচু অংশ থাকাসহ বেশ কয়েকটি কারণে ঘটছে এই সড়ক দুর্ঘটনা।
টানা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হওয়ার ঘটনায় কক্সবাজার চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নতি করণের দাবি জোরালো হচ্ছে। মরণফাঁদ থেকে বাঁচতে জনদাবি নিয়ে সর্বস্তরের মানুষ মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ সভা- সমাবেশ করছে। চার লেনের সড়কের দাবিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়, সাতকানিয়া, লোহাগাড়ায় মানববন্ধন করেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি)-র নেতাকর্মীরা। এছাড়াও সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার দেশের ব্যস্ততম মহাসড়কের একটি। এ সড়কের বেশিরভাগ অংশের প্রশস্ততা মাত্র ১৮-৩৪ ফুট। ফলে দূরপাল্লার গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। ১৪৮ কিলোমিটার পথ বাসে যেতে সময় লাগে ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টা। অতিরিক্ত বাঁক, উপসড়ক থেকে যত্রতত্র ছোট বড় গাড়ি মহাসড়কে উঠে আসার কারণে সড়কটি হয়ে উঠেছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা প্রবণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পলিথিন বিহীন ট্রাক ভর্তি লবণ পরিবহন। যেটি টেকনাফ, উখিয়া কক্সবাজার, মহেশখালী, পেকুয়া, বাঁশখালীতে উৎপাদিত লবণ। যার কারণে রাতের কুয়াশার সাথে লবণ পানি একাকার হয়ে সড়কটি মারাত্মক পিচ্ছিল করে তুলছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে ১৫৮ কিমি দীর্ঘ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক।
এদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটির অত্যাধিক ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষ করে মহাসড়কের হাশমতের দোকান, ঠাকুরদীঘি, উপজেলার পদুয়া, লোহাগাড়া শহর, আধুনগর, হাজি রাস্তা, চুনতি, জাঙ্গালিয়া এলাকা, চকরিয়া অংশের ইসলাম নগর ইমাম বুখারী মাদ্রাসা এলাকা, বানিয়ারছড়া ওরি আমগাছ তলা, হারবাং লালব্রীজ এলাকা আজিজ নগর, চকরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এলাকা, লক্ষ্যারচর জিদ্দা বাজার টার্নিং পয়েন্ট, মালুমঘাটের রিংভং ছগিরশাহকাটা ঢালা, ডুলাহাজারার পাগলিরবিল, খুটাখালী জাতীয় উদ্যান, নাপিত খালী, রামু রাবার বাগান।
গত বুধবার (৩ এপ্রিল) সকালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকায় ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ১১ জন। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন প্রেমা নামের এক নারী। পরে তাকে উদ্ধার চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থা শুক্রবার (৪ এপ্রিল) তার মৃত্যু হয়। একই দুর্ঘটনায় প্রেমার বাবা শামীম ফকির (৪০), মা সুমি আক্তার (৩৪), দুই বোন আনিসা (১৪) ও মাত্র চার মাস বয়সী ছোট বোন, এবং খালা তানিফা ইয়াসমিন (৩৫) মারা যান।
লোহাগাড়ায় গত ৩১ জানুয়ারি সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে চারটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। সবগুলো দুর্ঘটনাই ঘটেছে চুনতি ইউনিয়ন এলাকার ২ কিলোমিটার মহাসড়কের মধ্যে।
গত মঙ্গলবারও রাত ৮টার দিকে সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা রাজঘাটা এলাকায় এসআই পার্কের সামনে লবণের পানিতে পিচ্ছিল সড়কে বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সাইফুদ্দিন জামিল নামে এক যুবক নিহত ও তার বন্ধু রেজাউল করিম আহত হন। পরেরদিন বুধবার রাত ২টার দিকে হাসমতের দোকান এলাকায় পিচ্ছিল সড়কে সবজি বোঝাই একটি ট্রাক উল্টে যায়। এছাড়া, ১৩ ফেব্রুয়ারি সকালে ঠাকুরদীঘি ছগির আহমদ অটো ফিলিং স্টেশনের সামনে দুটি কাভার্ড ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে অন্তত ৫ জন আহত হন।
২০২৩ সালের ১৮ মার্চ রাত ১টার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চুনতি ইউনিয়নের বনপুকুর এলাকায় বাস-লরি ও রাত দেড়টায় আধুনগর ব্রিজ এলাকায় বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৯ জন আহত হন। এইদিন ভোর ৫টার দিকে লোহাগাড়া ও চকরিয়া উপজেলা সীমান্তবর্তী আজিজনগর এলাকায় কক্সবাজারগামী সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে উল্টে যায়। এতে চালক এরশাদ মন্ডল (৩০) ও হেলপার শিব্বির আহমদ মারুফ (১৯) ঘটনাস্থলে নিহত হন। গত ৫ মার্চ একই স্থানে বিজিবির বাসের সঙ্গে যাত্রীবাহি লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হন।
লবণবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত পানিতে পিচ্ছিল হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। ফলে বিপজ্জনক এ মহাসড়কে প্রতিদিন দুর্ঘটনায় বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। লবণবাহী গাড়িতে ত্রিপল ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিদিন শত শত ট্রাকে লবণ পরিবহন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে লবণের পানি পড়ে পিচ্ছিল হচ্ছে সড়ক। মহাসড়কটির কক্সবাজারের ঈদগাঁও থেকে চকরিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ ও পটিয়া পর্যন্ত এলাকায় লবণবাহী ট্রাক চলছে অবাধে। বেশিরভাগেরই নেই পর্যাপ্ত লবণ পানি আটকে রাখার ব্যবস্থা।
সস্প্রতি মহাসড়কটির চকরিয়া উপজেলায় ১৫টি দুর্ঘটনায় ১০ জনের প্রাণহানি ও আহত হয়েছেন অনেকে। ত্রিপল ছাড়া খোলা ট্রাকে লবণ পরিবহনের কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।
দোহাজারী হাইওয়ে পুলিশের ওসি খাঁন মোহাম্মদ এরফান বাংলানিউজকে বলেন, শুধুমাত্র লবণবাহী ট্রাকের কারণেই দুর্ঘটনা বাড়ছে-এমন কিন্তু নয়। বিভিন্ন কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে চালকদের অসতর্কতা, ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, প্রতিযোগিতা দিয়ে গাড়ি চালানো ইত্যাদি কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।
তিনি আরও বলেন, রাতে ও ভোরে মহাসড়কটির অবস্থা দেখলেই বুঝা যাবে- পরিবহনের সময় ট্রাক থেকে নিঃসৃত লবণ পানিতে পিচ্ছিল হয়ে উঠছে এ মহাসড়ক। ব্রেক কষলেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়ছে যানবাহন।
চাঁদাবাজি
লবণবাহী গাড়িতে ত্রিপল ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও তা মানছেন না চালকেরা। এতে লবণবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত পানিতে পিচ্ছিল হচ্ছে সড়ক। এসব গাড়ি হাইওয়ে পুলিশ আটক করলেও টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। যার কারণে চালকেরা ত্রিপল ব্যবহারের অনীহা দেখায়। এ বিষয়ে পুলিশকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *