মোঃ খলিলুর রহমান সাতক্ষীরা :
সাতক্ষীরার উপকূলীয় অ ল এলাকায় প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরুতে পানির জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে। উপকূলজুড়ে পানি থৈ থৈ করলেও সুপেয় পানি কোথায় নেই, সবটাই লবণাক্ত। চৈত্রের খরায় প্রাকৃতিক উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, লবণাক্ততা বেঢ়ে সুপেয় পানির আধার নষ্ট হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মিলছে না সুপেয় পানি। গ্রীষ্মের সময় থেকে বিগত ১২ বছর যাবৎ চলতে থাকা এ সমস্যার কারণে উপকূলের জনপদে মারাত্বক প্রভাব ফেলেছে।
বর্তমানে এক কলস সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন উপকূল অ লের নারী-পুরুষসহ শিশুরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করার দৃশ্য উপকূলবাসীর নিত্যদিনের কাজ। অপরদিকে নিত্যদিনের কাজে উপকূলীয় অ লের মানুষরা লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন রোগব্যাধি। অতিমাত্রায় লবণাক্ততা এখন উপকূলবাসীর জন্য প্রধান দুর্যোগ, যা মোকাবেলায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে প্রান্তিক মানুষরা। বর্তমানে বিশুদ্ধ পানির সংকটে টাইফয়েড, ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন উপকূলীয় এলাকার মানুষরা।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে বলে জানানো হলেও বাস্তবে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। পানি সংকট নিরসনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে উপকূলজুড়ে খাবার পানির জন্য পুকুর খনন, টিউবওয়েল স্থাপন, পন্ডস এন্ড ফিল্টার (পিএসএফ) স্থাপন এবং বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করলেও সুপেয় পানির সংকট দূর হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লির্ডাস, ব্রেড ফর দ্যা ওয়ার্ল্ডসহ জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরামের তথ্যমতে, ‘সাতক্ষীরা জেলার ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮১ জন মানুষের ভিতরে উপকূলের ৫ লক্ষাধিক মানুষ সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে।’ এ কারণে উপকূলীয় অ লে সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারকে টেকসই, জনবান্ধব ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করার কথা জানান সংশ্লিষ্টরা।
সূত্রে জানা যায়, ‘২০০৯ সালে আইলা তাণ্ডবের পর সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জসহ গোটা উপকূলীয় এলাকাজুড়ে সুপেয় পানির তীব্র সংকট হয়। ওই বছর জলোচ্ছাসের কারণে নষ্ট হয়ে যায় সুপেয় পানির উৎস। এদিকে বিকল্প হিসেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও পুকুরের পানি ফিল্টারিংয়ের জন্য ৬৫০টি মেশিন বসানো হলেও বেশিরভাগ হয়ে পড়েছে অকেজো।’
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, ‘প্রতি লিটার পানিতে ০ থেকে ১ হাজার মিলিগ্রাম লবণ থাকলে সেই পানি পানযোগ্য। কিন্তু উপকূলে প্রতি লিটার পানিতে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার মিলিগ্রাম লবণ রয়েছে। এ কারণে সুপেয় পানির সংকট দূর করতে জেলার ১৩২টি পুকুরের মধ্যে ৭৩টি পুনঃখনন হয়েছে। বাকিগুলোও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
উপকূলীয় এলাকাবাসীরা বলেন, আমাদের এলাকায় খাওয়ার পানির খুবই সমস্যা। দুই-তিন কিলোমিটার দূরে কলসি নিয়ে পানি আনতে যেতে হয়। সেখানে যেয়ে আবার লাইনে দাঁড়াতে হয়। খাবার পানি সংগ্রহ করতে দিনের তিন-চার ঘণ্টা চলে যায়। খরা মৌসুমে আমাদের এলাকায় পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। পানির জন্য এই কষ্ট যে কবে দূর হবে তা জানি না। চারদিকে পানি থই থই করছে। কিন্তু, কোথাও খাওয়ার পানি নেই। বাবা আমরা এখন আর কিছু চাই না, শুধু পানি দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রাখেন।’
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আইলার পর থেকে সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। সুপেয় পানির জন্য গভীর নলকূপ ও পানির বড় ট্যাংকের ব্যবস্থা আছে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে সরকারি এবং বেসরকারি পানির ট্যাংকি প্রদান করা হয়েছে। যেসব এলাকার গভীর নলকূপ থেকে লোনা পানি উঠে সেসব এলাকায় পুকুর কেটে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাতক্ষীরা উপকূলে প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে লোকালয়ে লবণ পানি প্রবেশ করছে এবং খাবার পানির আঁধারগুলো নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরা উপকূলের সব স্থানে গভীর নলকূপ সাকসেস হয় না। যেসব এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপন করা দরকার সেখানে নলকূপ স্থাপন করা হচ্ছে। আর এলাকার যেসব গভীর নলকূপ থেকে লোনা পানি উঠে সেসব এলাকায় পুকুর কেটে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেসব এলাকায় লবণাক্ততা বেশি সেই এলাকায় আরও প্ল্যান্টের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। আশা করছি খুব দ্রুত এই অ লের পানি সমস্যার সমাধান হবে।