নলডাঙ্গা(নাটোর)প্রতিনিধিঃ
নাটোরের হালতিবিলের বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠ। চারিদিকে বাতাসে দোল খাচ্ছে সোনা রাঙ্গা ফসল বোরো ধান। কোথাও কাঁচা-পাকা, কোথাও আধা পাকা আবার কোথাও বা পরিপুর্ণ ভাবে পাকা সোনালী শীষ। যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকে শুধুই চোখে পড়ে বোরো ধানের সবুজ ও সোনালী শীষের সমারোহ।
আর এরইমধ্যে কৃষক ভাইয়েরা আছেন তাদের ফসল ঘরে তোলা নিয়ে কাঙ্খিত প্রতিক্ষায়। তবে মৌসুমের শুরুতে আগাম রোপনকৃত জমির পাকা ধান কাটাও শুরু করেছেন অনেক কৃষক। পুরোদমে ধান কাটা-মাড়াই কার্যক্রম শুরু হতে সময় লাগবে আরো সপ্তাহ খানেক।
কিন্তু তাতে বসে নেই কৃষকরা। ইতোমধ্যে তারা ধান কর্তনে শ্রমিকের সন্ধান, ধান কাটা-মাড়াই মেশিন সংগ্রহ, ধান রাখা গোলা ও খোইলান প্রস্তুতসহ কৃষি কর্মযজ্ঞে নিয়ে আছেন চরম ব্যস্ততায়। সেই সঙ্গে আছেন প্রকৃতি-পরিবেশ ও আবহাওয়া নিয়ে শঙ্কিত।
কারন দেশের উত্তর-পুর্বাঞ্চলে হাওড়ে আকষ্মিক বন্যায় বোরো ধান ডুবে কৃষকরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সেই দিক বিবেচনা করে হালতিবিলের কৃষকরা আছেন চরম দু:শ্চিন্তায়। ভালয় ভালয় ফসল ঘরে তুলতে পারলেই সফল হবেন তারা। তা না হলে হাওরাঞ্চলের কৃষকদের মত পরিনতি হতে পারে। এজন্য যত দ্রুত সম্ভব ফসল ঘরে তোলা যায়, তা নিয়ে কৃষকের যত ব্যস্ততা।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষকরা যাতে সময় মত এবং সুবিধাজনক পন্থায় বোরো ধান ঘরে তুলতে পারেন, সেজন্য জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগও বেশ তৎপর আছেন। তারা কৃষকদের সাথে যোগাযোগ করছেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনসহ ফসলের মাঠও পরিদর্শন করছেন।
কৃষি বিভাগ সুত্রে জানাযায়, বুধবার (২০ এপ্রিল) সকালে জেলার হালতিবিলে কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উদ্যোগে বোরো ধান কর্তন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে কাটা-মাড়াই কার্যক্রমের শুভ সুচনা করা হয়।
এতে উপস্থিত ছিলেন নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুখময় সরকার, উপজেলা কৃষি অফিসার ফৌজিয়া ফেরদৌস, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) সুমা খাতুন, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন অফিসার কিশোয়ার হোসেনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কৃষকরা। বোরো ধান কর্তন শেষে কৃষক ও শ্রমিকদের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিতরন করা হয়।
এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সুত্র জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় ৫৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারন করা হয়। এরমধ্যে হাইব্রিড জাত ৪ হাজার হেক্টর, স্থানীয় জাত ১০ হেক্টর ও উফসী জাত ৫৪ হাজার ১৯০ হেক্টর। যার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বোরোর চাষাবাদ হয়েছে।
প্রতি হেক্টরে গড় ফলন ৪ দশমিক ৬৪ মেট্রিক টন হিসাবে মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ১৫৮ মেট্রিক টন। এরমধ্যে হাইব্রিড ২১ হাজার ৫২০ মেট্রিক টন, উফসী জাত ২ লাথ ৫৩ হাজার ৬০৯ মেট্রিক টন ও স্থানীয় জাতের ধান ২৯ মেট্রিক টন।
গত বোরো মৌসুমে জেলায় ৫৭ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদেও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছিল সেখানে অর্জিত হয়েছিল ৫৯ হাজার ৩৩০ হেক্টর। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৪৭০ হেক্টর বেশি জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছিল। আর প্রতি হেক্টরে ৪ দশমিক ৭২ মেট্রিক টন হিসাবে মোট ধান উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৭৯ হাজার ৭৭৪ মেট্রিক টন। এই জেলায় চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলা ও গুরুদাপুর উপজেলা এবং হালবিল অধ্যূষিত নলডাঙ্গা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি পরিমান বোরো ধান চাষাবাদ হয়।
কৃষি বিভাগের দাবী, চলতি মৌসুমে প্রণোদনার আওতায় কৃষকরা বিনামূল্যে সার ও বীজ পাওয়ায় এবং আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় বোরোর আবাদ ভাল হয়েছে। ধান কেটে ঘরে তোলা পর্যন্ত আবহাওয়া অনুক’লে থাকলে এবারও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হবে। ইতোমধ্যে আগাম রোপনকৃত বোরো ধান কর্তনের পর সন্তষজনক ফলন পাওয়া গেছে। এছাড়া মান ভেদে প্রতিমণ বোরো ধান ১১০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, বোরোর বীজ রোপন থেকে এখনও পর্যন্ত আবহাওয়া ভাল থাকায় এবং প্রয়োজন মত সার ও পানি সেচ দেওয়ায় ফসলের পরিস্থিতি ভালই ছিল। কিন্তু গত সপ্তাহ খানেকের মধ্যে বোরো ধানে মাজড়া পোকার আক্রমন দেখা দেওয়ায় ধানের শীষ কেটে দিচ্ছে। এতে ধানের শীষে চিটা দেখা দিচ্ছে। ফলে ধানের ফলন নিয়ে চিন্তায় আছেন অনেকে।
খোলাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল গফুর জানান, এবছর তিনি আড়াই বিঘা জমিতে বোরোর আবাদ করেছেন। ফসলও বেশ ভাল হয়েছে। তবে মাজড়া পোকার আক্রমনে কিছুটা ক্ষতির শঙ্কায় আছেন। ইতোমধ্যে বোরো ধান প্রায় পেকে গেছে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে কাটা-মাড়াই সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
হালতি গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন জানান, ফসলের অবস্থা এখনও পর্যন্ত ভাল আছে। শেষ পর্যন্ত ভাল থাকলে এবং সঠিক সময়ে কাটা-মাড়াই সম্পন্ন করতে পারলে বাম্পার ফলন হবে। তবে মাঝ খানে একদিনের ঝড়ে হালতিবিলের কাঁচা-পাকা ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে। এতে ফলন নিয়ে কিছুটা শঙ্কা কাজ করছে। পুরো হালতিবিলের ধান কর্তন করতে স্থান ভেদে অন্তত এক মাস সময় লাগবে। একই কথা জানালেন দিঘীড়পাড়, কোচঁকুড়ি, খাজুরা, একডালা, পাটুল গ্রামের কৃষকরা।
নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার ফৌজিয়া ফেরদৌস জানান, হালতিবিলসহ তার উপজেলায় এ বছর ৮ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। ফসলের অবস্থা বেশ ভাল রয়েছে। দুই এক জায়গায় পোকার আক্রমন ও ঝড়ের প্রভাবে ধান মাটিতে লুটিয়ে পড়ার কারনে সার্বিক উৎপাদনে কোন প্রভাব পড়বে না। আশা করা হচ্ছে, বিগত বছরের ন্যয় এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হবে। এবার ফলনে কোন ঘাটতি হবে না।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাহমুদুল ফারুক জানান, খাদ্য শস্যে উদ্বৃত্ত এই জেলায় চলতি মৌসুমে বোরোর আশানুরপ আবাদ হয়েছে। কৃষকরা সময় মত সার, বীজসহ অন্যান্য উপকরন সঠিক ভাবে পাওয়ায় বোরো ধান চাষে কৃষকদের কোন প্রতিবন্ধিকতা ছিল না।
এছাড়া সরকারের দেয়া প্রণোদনার বীজ ও সার পেয়ে কৃষকরা উপকৃত হয়েছেন। ফসলের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী আশা করা হচ্ছে এবারও ফলন ভাল হবে। কৃষকরা যদি সঠিক ভাবে তাদেও ফসল ঘরে তুলতে পারেন এবং ফসলের ন্যায্য মূর্য পান, তাহলে অর্থনৈতিক ভাবে বেশ লাভবান হবে।