পদ্মা সেতু নিয়ে দেশ-বিদেশে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু নিজেদের টাকায় এই সেতু নির্মাণ করে ষড়যন্ত্রকারীদের সমুচিত জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক এবং অপমানের প্রতিশোধ। এই সেতু শুধু সেতু নয়, এটি প্রকৌশলজগতে এক বিস্ময়। বুধবার জাতীয় সংসদে পদ্মা সেতু নিয়ে আনা একটি প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের শরিক দলগুলোর সংসদ সদস্যরা এসব কথা বলেন।
জাতীয় সংসদে পদ্মা সেতু নিয়ে আনা একটি প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ সদস্যরা এসব কথা বলেন। জাতিকে পদ্মা সেতু উপহার দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাতে প্রস্তাবটি আনা হয়। প্রস্তাবটি সংসদে তোলেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী। প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীসহ মোট ৩৮ জন সংসদ সদস্য বক্তব্য দেন। বিকেল পাঁচটার কিছু সময় পর আলোচনা শুরু হয়। মধ্যে মাগরিবের নামাজের জন্য ২০ মিনিটের বিরতি ছিল। আলোচনা শেষ হয় রাত সাড়ে ১১টায়। আলোচনা শেষে ধন্যবাদ প্রস্তাবটি গ্রহণ করে সংসদ।
দুর্নীতির অপবাদ ও বিশ্বব্যাংক
আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করেছিল বিশ্বব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) পদে থাকার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করেছিলেন। এর সঙ্গে খুব ভালোভাবে জড়িত ছিলেন একজন সম্পাদক। ইউনূসকে এমডি পদে রাখতে তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) পরিবারের সদস্যদের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল বলেও জানান তিনি।
এমডি পদে ড. ইউনূস থাকতে না পারায় হিলারি ক্লিনটনকে (সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী) দিয়ে ফোন করানো হয়েছিল বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘টনি ব্লেয়ারের (সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) স্ত্রী শেরি ব্লেয়ারকে দিয়ে ফোন করিয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি আসলেন; সবার কথা—ইউনূসকে ব্যাংকের এমডি রাখতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, শুধু তা–ই নয়, স্টেট ডিপার্টমেন্ট (যুক্তরাষ্ট্র) দু–দুবার সজীব ওয়াজেদ জয়কে (প্রধানমন্ত্রীর ছেলে) ডেকে নিয়ে থ্রেট করেছে। তাঁকে বলেছে, তোমার মাকে বলো—এমডির পদ থেকে ইউনূসকে সরানো যাবে না।
দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি, আমার বোন রেহানা, আমার ছেলে—কেউ বাদ যায়নি। ড. মসিউর রহমান, আমাদের সচিব মোশাররফ, মন্ত্রী আবুল হোসেন—এঁদের ওপর যে জুলুম তারা করেছে এবং যখন অসত্য অপবাদ দিয়ে যখন পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করে দিল, তখন আমরা বললাম, আমরা নিজের টাকায় করব। অনেকে বোধ হয় ভেবেছিলেন, এটা অস্বাভাবিক। কিন্তু আমি বলেছিলাম, আমরা করতে পারব। এই আত্মবিশ্বাস আমার ছিল।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যেন টাকাটা (পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন) বন্ধ করে, তার জন্য বারবার ই-মেইল পাঠানো, হিলারির সঙ্গে দেখা করা, তাঁকে দিয়ে ই-মেইল পাঠানো এবং তাঁর সঙ্গে আমাদের একজন সম্পাদকও ভালোভাবে জড়িত ছিলেন।’
সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ‘এত চাপ। এই মামলা নিয়ে যে সমস্ত খেলা। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি। কার ডায়েরিতে লিখে রাখা ডিডটা হলে পরে অমুক এত পার্সেন্ট, অমুক এত পার্সেন্ট। এখানে মসিউর রহমান সাহেবের নাম, রেহানার নাম, নিক্সনের নাম। তারপর আমাদের আবুল হোসেনের নাম, সচিবের নাম। সবার নাম দিয়ে পার্সেন্টেজ লিখে রেখেছে। আমি যখন ডিমান্ড করলাম আমাকে কাগজ দাও। আমি দুর্নীতির এভিডেন্স চাই। একটা ডায়েরির কাগজ। পেনসিল দিয়ে লেখা। সেখানে তারিখ নেই। কিছু নেই। কোথায় বসে লিখেছে। এটা নাকি ওয়েস্টিন হোটেলে বসে লেখা।’
সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আমেরিকানদের জবাব দিয়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ, আমার সাথে তো হিলারি ক্লিনটন দেখা করতে এসেছিল। বলেছিল, এই এই কোম্পানিকে কাজ দিন। এবং ওই ওই কোম্পানিকে কাজ দিলে যে এত পার্সেন্ট পাবে। আমার ডায়েরিতে লেখা আছে। দেব বের করে? তখন চুপ হয়ে গেছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘একজন আন্ডার সেক্রেটারি এসে খুব হুমকি-ধমকি, অ্যাম্বাসেডর আসে বারবার অফিসারদের হুমকি দিতে। ইউনূসকে এমডির পদ থেকে বের করলে পদ্মার টাকা বন্ধ করা হবে। বুঝি না একটা এমডির পদের জন্য একটা দেশের এত বড় ক্ষতি!’
সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ড. ইউনূসকে কোনো অপমান করা হয়নি, বরং তাঁকে ব্যাংকের উপদেষ্টা ইমেরিটাস হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় গ্রামীণ ব্যাংককে সরকার ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছিল। গ্রামীণফোন যখন নেয়, তখন শর্ত ছিল এর লভ্যাংশ গ্রামীণ ব্যাংকে যাবে কিন্তু একটি টাকাও ব্যাংককে দেওয়া হয়নি। ড. ইউনূস প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘একজন ব্যাংকের এমডি এত টাকার মালিক হয় কীভাবে? দেশে-বিদেশে এত বিনিয়োগ করে কীভাবে? ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে লাখ লাখ ডলার কীভাবে অনুদান দেয়? কার টাকা দিল? কীভাবে দিল, সেটা তো কেউ খোঁজ নিল না।’
দেশের মর্যাদা উজ্জ্বল করেছে
পদ্মা সেতু নিয়ে নানা চাপ, মিথ্যা মামলার পরও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শুরুর পর থেকে বিশ্ব বাংলাদেশকে সমীহ করছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিনি, করব না।’ তিনি বলেন, পদ্মা সেতু আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। ভবিষ্যতে আরও উন্নত কাজ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ যে নিজেরা পারে, দেশের মর্যাদা সারা বিশ্বে উজ্জ্বল করেছে পদ্মা সেতু।
ভারতের ভূপেন হাজারিকা সেতুর সঙ্গে তুলনার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভূপেন হাজারিকা সেতু আর পদ্মা সেতুর তফাতটাই তারা জানে না, বুঝে না। কোথায় হিমালয় পর্বত আর কোথায় ছাগলে ঘাস খায়।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করার পাশাপাশি যারা দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল, তাদের কঠোর সমালোচনা করেন। অন্যদিকে পদ্মা সেতুতে বিপুল লুটপাট হয়েছে, এমন অভিযোগ এনে বিএনপির সংসদ সদস্য (সংরক্ষিত নারী আসন) রুমিন ফারহানা বলেন, এই সেতু দুর্নীতির ‘টেক্সট বুক এক্সাম্পল’ (পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরন)