মোঃ কবির হোসেন,স্টাফ রিপোর্টারঃচারদিকে নদীবেষ্টিত দ্বীপ জেলা ভোলা এর মধ্যে
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার মেঘনা-তেতুঁলিয়া সংলগ্ন ৭ ইউনিয়নের প্রায় ৬ হাজারের অধিক শিশুর শিক্ষাজীবন সুতার জালে বন্দি হয়ে আছে। ৭ থেকে ১২ বছর বয়সের ওই সকল শিশু কখনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দরজা মারায়নি । করোনার তান্ডব, নদী ভাঙ্গন,দারিদ্রতা ,অভিভাবকদের অজ্ঞতা,শিশু শ্রমিকদের কম মুজুরীর , আর সচেতনতার অভাবে শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে দ্বীপজেলার এসব শিশুরা। যেখানে হাসি-খুশি , আনন্দ-উল্লাসে বেড়ে ওঠার কথা, সেখানে শুধুই দারিদ্রের কষাঘাত। অনিশ্চয়তায় বিবর্ণ হয়ে ওঠে উপকূলের হাজারো শিশুর শৈশব।
যেসময়ে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেখানে তাঁরা এখন ব্যস্ত জাল আর নৌকা নিয়ে। স্কুল মাঠে খেলাধুলার পরিবর্তে তাঁরা মাছ শিকার করতে চষে বেড়াচ্ছে উত্তাল মেঘনা – তেতুঁলিয়ায়। দু’মুঠো ভাতের সন্ধানে শুধু জেলে, কৃষক ও হোটেল শ্রমিকই নয়- সব ক্ষেত্রে এদের সমান পদচারণা।
বোরহানউদ্দিন প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যে এ উপজেলার ১৫৬টি বিদ্যালয়ে(৪ থেকে ১০ বছরের) বর্তমান ছাত্র সংখ্যা ৩৩ হাজার ৭শত ৯৭জন। ২০২২ সালের শিশু জরিপে স্কুলে যায় না এমন শিশুর সংখ্যা ১৪৮০ জন। যদিও বেসরকারী ভাবে ৯ইউনিয়ন ও পৌরসভায় এর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার এ ধারনা অনেকের।
সরেজমিন পরিদর্শনে কথা হয় বড় মানিকা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের আলাউদ্দিনের ছেলে শিশু জেলে সোহাগ(১২) এর সাথে । ২ ভাই, বোনের মধ্যে সবার বড়। জাল বুনছেন। বর্তমানে শিশু জেলে। প্রাথমিকের গন্তি পার হওয়ার আগেই নৌকা আর জাল নিয়ে নেমে পড়েছে মেঘনায়। সোহাগ বলেন, এলাকার তৈমুদ্দিন উদ্দিন (মধ্যবাটামারা) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। সংসারে অভাব আর অভাব। এজন্য ৩/৪ আগে পড়া লেখা ছেড়ে দেই।
বড় মানিকা ৮ নং ওয়ার্ডের বাবুলের ছেলে সুজন(১৩)। নদীতে মাছ শিকারের জন্য জাল মেরামতের কাজে ব্যস্ত শিশু সুজন। স্থানীয় একটি মাদরাসায় ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলো। ৩ মাস হলো লেখা পড়া ছেড়ে দিয়েছে। অভাবের কারণে সংসার চলছে না। তাই বোন জামাই রিয়াদ মাঝির সাথে কাজ করছি। স্কুলে যাই না, মা-বাবাকে খাওয়ানো লাগে। তারা অসুস্থ্য, তাই তাদের খরচ চালাতে হয়। পড়ালেখা বাদ দিয়ে নদীতে জাল বাই। মেঘনা – তেতুলিয়া নদীর পাড়ের জেলে রুবেল হোসেন,সাত্তার মাঝি,মহিউদ্দিন,আলামিন,নিজাম জানান,মাছ না পাইলে, দু বেলা খাবার খাওয়া যেখানে কঠিন। সেখানে সন্তানদের পড়ামু ক্যামনে। জেলে হাসান বলেন ”জোবার সময় আসলে দেখবেন শত শত শিশুরা নদীতে মাছ ধরছে”। তারা জানায়, ইলিশ ও অন্যান্য মাছ শিকার করে চলে তাদের জীবিকা। অনেকে জেলে আর্থিক অনটনের কারণে নিজেদের শিশু সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালাতে পারেন না। ফলে শিশুরা প্রাথমিক শেষ করার আগেই বাবা, ভাই কিংবা অন্য কারও সঙ্গে জাল নিয়ে নদীতে নামছে। টবগী ইউনিয়নের ৪ নাম্বার ওয়ার্ডে বেড়িবাঁধে বাস করা আবু জাফর, নজরুল ইসলাম, কাজল মিয়া, আ. রব , ইয়াছিন জানান, তাদের বাড়ি ছিলো তজুমদ্দিন উপজেলার মলনচরা ইউনিয়নে। মেঘনা ঘর-বাড়ি কেঁড়ে নেবার পর উপায়ান্তর না দেখে এখানে বসতি গেড়েছেন। নদীতে মাছ ধরে কোন রকমে দিন চলে। তারা জানালেন, সংসার চালাতে না পেরে বাধ্য হয়ে তাদের সন্তানদের নদীতে মাছ ধরতে দিয়েছেন। তেতুলিয়া নদীর গংগাপুর ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের খোরশেদ, বশির, হেজন আলী, নুরে আলম জানান, পোলাপন পড়ে কি হবে, সংসারের কাজে লাগছে এটাই ভালো । তারা উল্টো প্রশ্ন করেন, পেলাপান স্কুলে দিলে খাবো কি?
উপজেলার বড়মানিকা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন হায়দার জানান,তার ইউনিয়নের ৫,৬,৮ নং ওয়ার্ড ৩টি মেঘনার তীরবর্তী এলাকায়।ওই ইউনিয়নের প্রায় ২হাজার শিশু নদীতে মাছ শিকারসহ বিভিন্ন ঝুকিপূর্ন কাজে নিয়োজিত। হাসাননগর ইউনিয়নের আবেদ চৌধুরী জানান, নদী সিকস্তি তার এলাকায় ৬ থেকে ১০ বছরের কমপক্ষে ৭০০ শিশু স্কুলে যায়না। পক্ষিয়া ইউনিয়নের
সাবেক চেয়ারম্যান নাগর হাওলাদার জানান, স্কুলে যায়না এরকম শিশু আছে ১ হাজারের মতো। কাচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রব কাজী জানায় তার ইউনিয়নে দারিদ্রতার কারণে হাজার খানিক শিশু স্কুলে যায় না। তবে ডিটিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান কাজী জানায় ওই ইউনিয়নের প্রায় ২ হাজার শিশু বিভিন্ন ঝুকিপূর্ন কাজে নিয়োজিত। দারিদ্রতার কারণে পিতামাতা তাদেরকে স্কুলে পাঠান না। । গঙ্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ রিয়াজ জানান, তেঁতুলিয়া নদী বেষ্টিত তার ইউনিয়নের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়না কয়েক শত শিশু। । টবগী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন জানান, নদী সংলগ্ন তার ইউনিয়নে ৭ শত শিশু স্কুলে যায়না। সাচড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহিবুল্যাহ মৃধা জানায়,তার ইউনিয়নে ৪শত শিশু বিভিন্ন ঝুকিপূর্ন কাজের সাথে জড়িত থাকার কারনে স্কুলে যেতে পারে না। দেউলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান জানান,স্কুলে যায় না এ রকম শিশু তার ইউনিয়নে কম।
মেঘনার কোলঘেসে অবস্থিত স্বরাজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আক্তার হোছাইন জানান, এক সময় স্কুল বেশ কোলাহল মুখর ছিল। করোনার পর সব শেষ। অষ্টম শ্রেণিতে বর্তমানে ৫ জন ছেলে আছে।অন্যরা স্কুলে আসে না।নদী সহ বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ছে। টবগী রাস্তার মাথা শরীফিয়া দাখিল মাদরাসার সুপার সহ নদীর তীরবর্তী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রধান বলেন, করোনার পরবর্তিতে সব এলোমোলো হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা নদীসহ বিভিন্ন কাজে জড়িত। ফরমফিলাপ কিংবা রেজিস্ট্রেশনের সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুজঁতে হয়।
বোরহানউদ্দিন উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আলী আহমেদ আকন্দ বলেন, এখানে ১৯ হাজার ৮৪ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। এরা সবাই ১৮ বছরের ওপরে। তিনি আরও বলেন, কত সংখ্যক শিশু নদীতে মাছ শিকারের কাজ করে তার হিসাব নেই।
জাতীয় মৎস্জীবি সমিতির সভাপতি শাহে আলম ও ক্ষুদ্র মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির সভাপতি আবু সাইদ মাঝি বলেন, কোনও জেলে বাবা যখন নৌকা চালাতে মানুষ না পান তখন নিজের ৮-১০ বছরের বাচ্চাদের নিয়ে যান নদীতে। শ্রমিকের মুজুরীঁ বেশি।ছোটদের ২-৩ শত টাকা দিয়ে খাটানো যায়। এ সব কারণে কয়েক হাজার শিশু মেঘ