মোঃ খলিলুর রহমান,সাতক্ষীরাঃ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে উপকূলে। এতে সহায়-সম্পদ হারানোর পাশাপাশি সুপেয় পানির সংকট, চিকিৎসার অভাব, নারী-শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা জীবনযাত্রা ও পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছে। উপকূলের এমন অবস্থার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। উপকূলের বাসিন্দারা বলছেন, উপকূলের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার উন্নয়নে কার্যকর কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এলাকায় কাজ না থাকায় বাড়িতে নারীদের রেখে কাজের সন্ধানে যাচ্ছেন পুরুষরা। তখন পরিবারের নারী-শিশুরা নানা নির্যাতন ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
স্থানীয়রা বাসিন্দা হাসনা বেগম বলেন,এ বছর বড় ধরনের ঝড় আসেনি। সেজন্য ঘরটি টিকে আছে। কিন্তু ঘরের কিছু অংশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় পড়ায় সরিয়ে নিতে বলেছেন সংশ্লিষ্টরা। না হলে ভেঙে দেবে বলে নোটিশ দিয়েছে। ঘর সরাতে অনেক টাকা খরচ হবে। কিন্তু টাকা পাবো কোথায়?
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দুর্গাবাঢী এলাকার শম্ভুজিত মন্ডল বলেন,আমাদের কষ্টের শেষ নেই। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমার ঘর অনেকবার ভেঙেছে। ২০১৯ সালে ফণীতে বাড়ি বিধস্থ হয়। স্থানীয় সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে আবারও ঘর তুলি। বছর না ঘুরতেই আম্পানের আঘাতে ভেঙে যায়। আবার ঋণ নিয়ে ঘর করলে পরের বছর ইয়াসে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। গত জুলাই মাসে বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ঘরটি। দুর্যোগে বারবার ঘর ভাঙে, বারবার ঋণ নিয়ে ঘর করি। ভ্যান চালিয়ে ঋণ শোধ করি। এভাবে জীবন চলে না। মন চায় অন্য জায়গায় চলে যাই। কিন্তু যাওয়ার জায়গা নেই।’
দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার মিজানুর রহমান বলেন,খরা,ঝড়,বৃষ্টি ও নদীভাঙন আমাদের নিত্যসঙ্গী। আইলার পর থেকে গোটা এলাকা উদ্ভিদশূন্য। লবণাক্ততার কারণে সব গাছ মারা গেছে। এলাকায় বসবাস করা খুবই কষ্টের। বাঁধের অবস্থা নাজুক। টেশশই বেড়িবাঁধ হলে পানি প্রবেশ করতো না। বাঁধ না থাকায় প্রতিবছর আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। পুরো বছর সুপেয় পানির অভাবে থাকতে হয়। খুব খারাপ অবস্থায় আছি আমরা।শুনেছি,এলাকার অনেকে খুলনা, নড়াইল ও বাগেরহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় চলে গেছেন। যারা আছেন তারা খুব কষ্টের মধ্যে দিন পার করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন,সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে মানুষ। লবণাক্ত পানিতে বসবাস করার ফলে চর্মরোগ,কলেরা,ডায়রিয়া,আমাশয়সহ পানিবাহিত রোগ লেগেই আছে। লবণাক্ত পানির জন্য নারীদের অকাল গর্ভপাত ঘটছে। ফলে বাড়ছে না জনসংখ্যা। কৃষিজমি নেই বললেই চলে। যা আছে তাতে ফসল হয় না। গো-খাদ্যের চরম সংকট। চিংড়ি চাষে দেখা দিয়েছে মন্দা। এখানে মানুষের বসবাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: আবু দাউদ ঢালী বলেন,আমার ইউনিয়নের একপাশে কপোতাক্ষ নদ আরেক পাশে খোলপেটুয়া নদী। দুই নদীর ২৫-৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অধিকাংশ এলাকা জরাজীর্ণ। প্রতিবছর নদীগুলোর পানি বাড়লেই লোকালয়ে ঢুকে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়। বাঁঁধগুলো ষাটের দশকে তৈরি। এরপর নামমাত্র সংস্কার হয়েছে। দুর্যোগে ঘরবাড়ি ও মাছের ঘের ভেসে নিঃস্ব হয়ে যায় মানুষ। দুর্যোগের পর তারা কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে,পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় বসবাস করবে,কোথায় যাবে এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে।ফলে অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। এখানে আশ্রয়কেন্দ্র নেই। স্থায়ী বাঁধ না হওয়ায় প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে উপকূল।
উপকূলীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল বলেন,দিনদিন পৃথিবীব্যাপী তাপমাত্রা বাড়ছে। সে কারণে দুর্যোগও বাড়ছে। এসব দুর্যোগ বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানে। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে লবণাক্ততা বাড়ছে। মাছ চাষ, কৃষি ও চাষাবাদ ব্যাহত হয়েছে। এখানের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস চিংড়ি চাষ। অথচ এখন চিংড়ি চাষ কমে গেছে। বহু মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ছে। এখানের পুরুষরা তাদের সন্তান-স্ত্রীদের রেখে অন্য এলাকায় কাজের সন্ধানে চলে যাচ্ছেন। অনেকে এলাকায় ফিরছেন না। অনেক পুরুষ অন্য এলাকায় গিয়ে বিয়ে করে স্থায়ী হচ্ছেন। ফলে বোঝা টানতে হচ্ছে নারীদের। অনেক ক্ষেত্রে ওই পরিবারের নারীরা হয়রানির শিকার হন। এখানে বসবাসের জন্য স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করলে কয়েক বছর পর এসব এলাকায় মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সাতক্ষীরা জলবায়ু পরিষদের আহ্বায়ক আশেক-ই-এলাহী বলেন, খুলনা-সাতক্ষীরা উপকূলকে বিশেষ দুর্যোগপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করতে হবে। এই ঘোষণার ফলে সরকারের নজর পড়বে। সেইসঙ্গে সমন্বিতভাবে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য একটি কমিটি দরকার। যারা প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারকে দেবে। তার আলোকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবে সরকার।
জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব পড়ছে উপকূলীয় এলাকায়। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা ও মাটির লবণাক্ততা উপকূলের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শীতের সময় অধিক শীত, গরমে প্রচন্ড গরম এবং বর্ষায় অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা বাড়ছে। এছাড়া জলোচ্ছ্বাসে নদীভাঙন বাড়ছে। ফলে এসব এলাকার মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে।
তিনি বলেন,২০০৭ সালের পর এই অঞ্চলে ২০টির অধিক ঝড় আঘাত হেনেছে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) সাতক্ষীরা উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. বাবুল আক্তার বলেন,জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় দিন দিন লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলের মাটি ও পানি পরীক্ষা করে দেখেছি,উপকূলীয় এলাকায় ৮ ডিএস মিটারের নিচে লবণাক্ততা কখনও নামে না। লবণাক্ততা ৩-৪ ডিএস মিটার থাকলে ধান উৎপাদন কঠিন হয়ে যায়। নিয়মিত এই মাত্রার লবণাক্ততার মধ্যে মানুষ বসবাস করলে শারীরিকভাবে বিভিন্ন সমস্যা হয়। প্রতিবছর যেভাবে লবণাক্ততা বাড়ছে তাতে একসময় উপকূলীয় এলাকা বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়বে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আক্তার হোসেন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে এই এলাকার কৃষিজমি কমে গেছে। সে কারণে অনেক মানুষ ইটভাটা এবং দিনমজুর হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় কাজের জন্য যান। কাজের মৌসুম শেষ হলে তারা আবারও ফিরে আসেন। মানুষকে যাতে এলাকা ছাড়তে না হয় সেজন্য কৃষিজমি বৃদ্ধি ও কৃষির উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি আমরা। টেকসই বাঁধ নির্মাণ হলে নোনা পানি লোকালয়ে প্রবেশ করবে না। এদিকে সরকারের নজর আছে। তারই ধারাবাহিকতায় উন্নয়নকাজ চলছে।