শিহাবুর রহমান শাকিব, ঢাকাঃ বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তৃতির আশঙ্কার মধ্যেই শনিবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে উদযাপিত হচ্ছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শুভ বড়দিন। এদিন দেশের সব গির্জায় অনুষ্ঠিত হয়েছে করোনা মহামারি থেকে মুক্তি এবং সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের শান্তি-সমৃদ্ধি কামনার আনুষ্ঠানিক প্রার্থনা। দুঃসময় কেটে সামনের দিনগুলোতে সকলের জীবনে আনন্দ বার্তা বয়ে আসুক— এমন কামনাও করা হয়েছে বড়দিনের খ্রিষ্টযোগে।
তবে করোনার বিধিনিষেধ মেনে এ বছর সারাবিশ্বের মত বাংলাদেশেও বড়দিনের আয়োজন অনেকটাই সীমিত রাখা হয়েছে। গির্জাগুলোতে জনসমাগম সীমিত রেখে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পালন করা হয়েছে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। বড়দিন শনিবার হলেও আগেরদিন শুক্রবার রাত থেকেই উৎসবে মেতে ওঠেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা, তাদের বাড়ি বাড়ি শুরু হয় উৎসব। পাশাপাশি অভিজাত হোটেলগুলোতেও করা হয় বিশেষ আয়োজন। শনিবার সকাল থেকেই এই উৎসব পূর্ণতা পায়।
রাজধানীর তেজগাঁও ক্যাথলিক গির্জা হোলি রোজারিও চার্চে (পবিত্র জপমালা রাণীর গির্জা) শনিবার সকাল ৭টায় শুরু হয় প্রথম প্রার্থনা সভা। এই প্রার্থনা সভা পরিচালনা করেন গির্জার প্রধান ফাদার সুব্রত ডি গোমেজ। বিরতি দিয়ে আবার সকাল ৯টায় শুরু হয়ে ১০টায় শেষ হয় দ্বিতীয় দফার প্রার্থনা। গির্জার আর্চবিশপ বিজয় এন ডি ক্রজ এই প্রার্থনা পরিচালনা করেন এবং খ্রিষ্টযোগে অংশ নেন। আগের দিন সন্ধ্যা ৭টায় এবং রাত ১০টায়ও সেখানে খ্রিষ্টযোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রার্থনায় আর্চবিশপ বিজয় এন ডি ক্রজ দেশের মানুষের শান্তি কামনা ও করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির প্রত্যাশা প্রকাশ করে বলেন, বড়দিনের এই মুহূর্তে আমরা প্রার্থনা করি, সারাবিশ্ব ও প্রতিটি মানুষ যেন এই মহামারি থেকে মুক্তি লাভ করেন। যাতে আবার আমরা সুখ-শান্তিতে একাত্মতার মধ্যে জীবনযাপন করতে পারি। এরপর তিনি যীশুর অনুসারীদের পাপ স্বীকার (কনফেশন) করান।
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শুভ বড়দিন উদযাপিত হচ্ছে শনিবার। সকালে রাজধানীর তেজগাঁও গির্জা থেকে তোলা ছবি – ফোকাস বাংলা
কাকরাইলের সেন্ট মেরিস গির্জায় শনিবার সকাল ৮টায় প্রার্থনা শুরু হয়ে ৯টায় শেষ হয়। প্রার্থনায় যাজক বলেন, বিশ্বব্যাপী সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি হোক। করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোর মানুষের শান্তি বজায় থাকুক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জন্মশতবর্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও স্মরণ করা হয় প্রার্থনায়।
রাজধানীর রমনা ক্যাথেড্রাল চার্চে সকাল ৮টায় বড়দিনের খ্রিষ্টযোগ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া মহাখালীর লুর্দের রানীর গির্জা, লক্ষ্মীবাজারের ক্রুশ ধর্মপল্লী, মোহাম্মদপুরের সেন্ট ক্রিস্টিনা গির্জা, মিরপুর-২ এর মিরপুর ক্যাথলিক গির্জা, কাফরুলের সেন্ট লরেন্স চার্চ এবং মণিপুরীপাড়া ও বারিধারাসহ বিভিন্ন এলাকার গির্জাগুলোতে বড়দিনের বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। এসব প্রার্থনার বড় অংশজুড়ে ছিল করোনা মহামারি থেকে যেন সবার মুক্তি মেলে। সেই প্রার্থনায় পরমেশ্বরের কাছে নশ্বর জীবনের নানা ভুলভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চেয়েছেন ভক্তরা। প্রার্থনায় অংশ নেওয়া নানা বয়সী মানুষের অনেকেই গির্জায় থাকা সমাধিতে গিয়ে মৃতদের জন্যও প্রার্থনা করেছেন।
প্রার্থনা ছাড়াও বড়দিনের অন্যান্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলোও উদযাপিত হয়েছে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে। সকাল থেকে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা নতুন পোশাক পড়ে পরিবারসহ বড়দিনের প্রার্থনাসহ অন্য আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দেন। গির্জার প্রবেশমুখে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ছিল।
শনিবার উদযাপিত হচ্ছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শুভ বড়দিন। সকালে রাজধানীর তেজগাঁও গির্জা থেকে তোলা ছবি – ফোকাস বাংলা
ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে গির্জাগুলোর ভেতর এবং খ্রিস্টানদের ঘরে ঘরে বেথলেহেমের গরিব কাঠুরের গোয়ালঘরে যিশু খ্রিষ্টের জন্মের কথা স্মরণ করে বর্ণাঢ্য সাজসজ্জায় প্রতীকী গোশালা বসানো হয়। গোশালায় ছিলেন শিশু যিশু খ্রিস্ট। ঐতিহ্যবাহী এই সাজসজ্জায় রঙিন কাগজ, ফুল ও আলোর বিন্দু দিয়ে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয় দৃষ্টিনন্দনভাবে। আরও ছিল বিশেষ খাবারের আয়োজনসহ সীমিত আলোকসজ্জা। তবে গির্জার বাইরে আনন্দ-উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোকসজ্জা সীমিত রাখার পাশাপাশি বড়দিন উপলক্ষে মেলার আয়োজন বন্ধ রাখা হয়েছিল।
এদিকে, করোনার প্রকোপ অনেকটাই কমে আসায় এবার রাজধানীর পাঁচতারকা ও অভিজাত হোটেলগুলোর আয়োজনে জৌলুস ফিরে এসেছিল। প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, র্যাডিসন, লা মেরিডিয়েন, ওয়েস্টিন, হোটেল ওয়েসিস এবং ঢাকা রিজেন্সি হোটেলসহ বড় হোটেলগুলো সাজানো হয়েছিল রঙিন বাতি আর ফুল দিয়ে। সাজানো হয়েছিল ক্রিসমাস ট্রি। বড়দিনের কেক কাটার পাশাপাশি বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখর ছিল সব হোটেল। ছিল সান্তাক্লজের চমকপ্রদ উপস্থাপনা ও শিশু-কিশোরদের জন্য নানা উপহার। বড়দের পাশাপাশি শিশু-কিশোররা দিনভর খেলাধুলা ও বর্ণাঢ্য আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠেছিল।
বড়দিনের উৎসবকে ঘিরে দেশের সব গির্জার পাশাপাশি অনুষ্ঠানস্থলে ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মোতায়েন ছিলেন পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। আর্চওয়ে ও তল্লাশির মধ্য দিয়ে চার্চে প্রবেশ করতে হয়েছে সবাইকে। ঢাকা মহানগরের ৬৫ গির্জা ও আশপাশ এলাকা সিসিটিভির আওতায় নেওয়া হয়েছে।