শাহজাদপুর,সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বেলতৈল ও জালালপুর ইউনিয়নের চর বেলতৈল এবং মূলকান্দী মোল্লা পাড়া গ্রামের মানুষ চলাচলের জন্য পায়নি রাস্তা। তাই স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পেড়িয়ে গেলেও জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে কেবল পেয়েছেন প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সামান্য পায়ে হাটার রাস্তা তৈরিরও উদ্যোগ নেয়নি কেউ। এজন্য চর বেলতৈল এবং মূলকান্দী মোল্লা পাড়া গ্রামসহ টোক পাড়া, গাবের পাড়া, চৌবাড়ীয়ার প্রায় ১০ হাজার মানুষের দূর্ভোগ যেন আজন্ম সঙ্গী। অথচ এই গ্রামগুলোতে অন্তত ১শত বছর আগে থেকে বসতি গড়ে উঠেছে।
প্রাচীন এই গ্রামগুলোর মানুষের জন্য এক শতাব্দীতেও রাস্তা নির্মাণ না করায় সকলের বাড়ির চেপা-চাপাই হয়ে ওঠে কোনরকমে পায়ে চলার পথ। তবে সময়ে সাথে বদলে যাওয়া পরিবেশের কারনে এবং মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ির উপর দিয়ে চলাচল হয়ে উঠেছে অসম্ভব। বর্ষাকালে নৌকাযোগে চলাচল করলেও বাকীটা সময় জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। বিশেষ করে অসুস্থদের হাসপাতালে নিতে হলে কষ্ট যেন আকাশ ছোঁয়। এরপর গ্রামের কেউ মারা গেলে কবর পর্যন্ত পৌছাতে দূর্বিপাকের শেষ থাকেনা গ্রামবাসীর। এরপর স্কুল, কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের তো সীমাহীন ভোগান্তি নিত্যদিনের। সম্প্রতি ঐ গ্রামের একজন অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে সন্তান প্রসবের জন্য কোলে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়ে ঘটেছে মর্মান্তিক ঘটনা। পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সন্তান প্রসব হয় এবং মারা যায়। সেই গৃহবধূও এখন রয়েছেন চিকিৎসাধীন।
গ্রামবাসীর একশ বছরের এই দূর্ভোগ এবং সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গৃহবধূর দূর্ঘটায় অন্তরে নাড়া দেয় সমাজকর্মী ইঞ্জিনিয়ার আল মাহমুদের। তিনি ছুটে যান গ্রামের মানুষদের কাছে এবং বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে। কিন্তু আপাতত সরকারি ভাবে কোনরকম সহযোগিতা পাওয়া যাবেনা জেনে কিছুটা হোঁচট খেলেও দমে যাননি তিনি। সিদ্ধান্ত নেন গ্রামবাসীর কাছে থেকে চাঁদা তুলেই হবে রাস্তা। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন কয়েক লাখ টাকা এবং গ্রামবাসীর কিছুটা জায়গা। এজন্য গ্রামের সকলের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে অবশেষে রাজি হয়ে যায় পুরো গ্রামবাসী। এরপর বিরতিহীন ভাবে গত দুই সপ্তাহ ধরে চলছে মাটি ভরাটের কাজ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চর বেলতৈল এবং মূলকান্দী মোল্লা পাড়া গ্রামের মানুষ তাদের নিজ খরচে তৈরি করছে ১২ ফিট প্রস্থের দেড় কিলোমিটার মাটির রাস্তা। আর এই নির্মাণ কাজে গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত যে যার মত করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। একটি এক্সেভেটর মেশিন (ভেকু) দিয়ে পাশের সরু জলা থেকে মাটি তুলে চলছে নির্মাণ কাজ। আর গ্রামবাসীর স্বপ্নের রাস্তাটিতে যেন কোনরকম খাঁদ না থাকে তার জন্য যারযার বাড়ির সামনে কোদাল-টুকরি নিয়ে কাজে লেগে পড়ছেন নিজেরাও।
গ্রামবাসীর এই মহাকর্মযজ্ঞে যিনি প্রতিনিয়ত উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছেন তিনি সমাজকর্মী ইঞ্জিনিয়ার আল মাহমুদ। শাহজাদপুর সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে জনদূর্ভোগ নিয়ে স্যোসাল মিডিয়ায় নিয়মিত কথা বলা এই মানুষটি জানান, তাঁর নিজ গ্রামেও চলার কোন রাস্তা ছিলোনা বছরখানেক আগেও। তাই তার পিতা অসুস্থ হলে রাস্তা না থাকায় সময় মত হাসপাতালে নিতে পরেননি বলে মারা যায় বাবা। সেই থেকে স্যোসাল মিডিয়ায় নিয়মিত বিভিন্ন রাস্তার জনদূর্ভোগ নিয়ে কথা বলে চলছেন।
এ বিষয়ে কথা হলে ইঞ্জিনিয়ার আল মাহমুদ বলেন, চর বেলতৈল এবং মূলকান্দী মোল্লা পাড়া গ্রামসহ আশেপাশের ৫টি গ্রামের ১০ হাজার মানুষের চলাচলের জন্য পায়ে হাটার রাস্তাও নেই। এজন্য কিছুদিন আগেই একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে কোলে করে হাসপাতালে নেওয়ার সময় পড়ে গিয়ে গর্ভের সন্তান সাথে সাথে ভূমিষ্ট হয় এবং মারা যায়। এখন সেই গৃহবধুও মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন। মানুষের এই অসহায়ত্ব সহ্য করতে না পেরে গ্রামবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের টাকা দিয়েই শুরু হয়েছে রাস্তা নির্মাণ।
চর বেলতৈল গ্রামের বয়োবৃদ্ধ মোঃ ফটিক খা (৭০), মোঃ মধু মিয়া (৫০) ও মোঃ আলতাফ মোল্লা জানান, জন্মের পর থেকে তারা এই গ্রামে রাস্তা দেখেননি। কৃষিনির্ভর এই গ্রামগুলোতে রাস্তা না থাকায় একদিকে যেমন কৃষিজাত পণ্য পরিবহনে ব্যাপক কষ্ট অন্যদিকে কেবল রাস্তার অভাবে এ গ্রামের মেয়েদের ভালো জায়গায় বিয়ে পর্যন্ত হয় না। ইতোপূর্বে অনেক নেতা অনেক রকম প্রতিশ্রুতি দিলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। সবশেষে ইঞ্জিনিয়ার আল মাহমুদের আহ্বানে গ্রামবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেরাই নিজেদের চলার পথ তৈরি করছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে বেলতৈল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, গ্রামবাসী উদ্যোগ নিয়ে রাস্তাটি তৈরি করেছে। ওখানে আমরা প্রকল্প দিয়ে আরও সুন্দর করবো। সেইসাথে রাস্তাটি পাকাকরণের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো।
এদিকে নিজেরাই নিজেদের চলার পথ তৈরি করতে পেরে গ্রামগুলোতে শুরু হয়েছে উৎসব আমেজ। এ অঞ্চলের বসবাসরত ১০হাজার মানুষের চলাচলের পথ তৈরি করে পেয়েছে শতবর্ষের দূর্ভোগ থেকে মুক্তি আর কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ঠিকানা।