গ্রামের হৃদয়ে জ্ঞানের আলোর দীপ্তি: হারুন অর রশিদ স্মৃতি পাঠাগার


নদীবিধৌত ভোলার শান্ত স্নিগ্ধ প্রান্তরে, ধনিয়া ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী গঙ্গা কির্তী গ্রামে ২০০৩ সালে জন্ম নেয় এক আলোকবর্তিকা—হারুন অর রশিদ স্মৃতি পাঠাগার। একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে, নিঃস্বার্থ এক মননের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পাঠাগারটির সূচনা হয়েছিল নাছির মাঝি সড়কের শাপলা বাজারের এক কোণায়। তখনও কেউ জানত না—এই ছোট্ট পাঠাগার একদিন হয়ে উঠবে জেলার সাহিত্যচর্চার প্রাণকেন্দ্র, হবে এক নতুন প্রজন্মের বইপড়ার পাথেয়। আজ দুই দশক পেরিয়ে পাঠাগারটি শুধু একটি সংগ্রহশালা নয়, হয়ে উঠেছে এক প্রাণন্তচঞ্চল বিদ্যালয়। পাঠাগারের বুকজুড়ে শোভা পাচ্ছে নানা বিষয়ভিত্তিক সহস্রাধিক বই, রয়েছে দেশ-বিদেশের সাহিত্যকর্ম, বিশ্বজোড়া বিশ্বকোষ, এমনকি বহু দুর্লভ পাণ্ডুলিপিও। প্রতিদিনই এখানে আসে পাঠক—কেউ গল্প পড়ে, কেউ ইতিহাসের খোঁজে ডুবে যায়, কেউবা কবিতার ছায়ায় নিজেকে খুঁজে পায়। ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বর, পাঠাগারটি একটি নতুন পালক যুক্ত করে ইতিহাসে—ভোলা সরকারি গণগ্রন্থাগার-এর সহায়তায় এটি তালিকাভুক্ত গ্রন্থাগার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই গৌরবের পেছনে নিবেদিত প্রাণ এক মানুষের অবদান অনস্বীকার্য—ভোলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের পরিচালক মোঃ সবুজ খান। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছার ফলে পাঠাগারটি সরকারি তালিকাভুক্তির মর্যাদা পায়, যা ভবিষ্যতের পথচলায় এটি আরও দৃঢ় ভিত্তি পেতে সাহায্য করবে। হারুন অর রশিদ স্মৃতি পাঠাগার শুধু পাঠের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি ভোলা জেলার কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীদের এক মিলনমেলাও। নিয়মিত আসা-যাওয়ার মাধ্যমে তাঁরা পাঠাগারটির পরিধি বাড়িয়েছেন, যুক্ত করেছেন মূল্যবান সাহিত্যকীর্তি, বুনেছেন জ্ঞান ও কল্পনার এক অনন্য জগত। জীবনের প্রতিরূপ পাঠাগারে– আমাদের সমাজে যেখানে ডিজিটাল আসক্তি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে, ছোট-বড় সবাই মোবাইল স্ক্রিনে ডুবে থাকছে ফেসবুক ও নানা অশালীন অনলাইন কনটেন্টে, সেখানে এই পাঠাগার যেন এক শুদ্ধ বাতাস। আজকের প্রজন্ম বইয়ের পাতায় নয়, মোবাইল অ্যাপসে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে ব্যস্ত। এই আশঙ্কার জায়গা থেকেই জন্ম নেয় পাঠাগারটির সম্প্রসারণ পরিকল্পনা। বর্তমানে পাঠাগারটির নতুন ভবন নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পাঠাগারটি আরও বিস্তৃত পরিসরে, আরও অনেক পাঠক ধারণে সক্ষম হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটি শুধু বই পড়ার জায়গা নয়, হয়ে উঠবে এক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক শিক্ষার কেন্দ্র। একটি স্বপ্ন, একটি সংকল্প, একটি আলোর পথচলা— পাঠাগারটি শুধু পাঠচর্চার নয়, সামাজিক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয়। হতদরিদ্রদের সহায়তা, বয়স্ক শিক্ষা, নারী শিক্ষা—এইসব কার্যক্রম পাঠাগারের ছায়াতলে গড়ে উঠছে। সকালে শিশুদের মক্তব পড়া দিয়ে শুরু হয়ে, দিনভর পাঠচর্চা আর সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা—এই চক্রাবর্তে পাঠাগারটি হয়ে উঠেছে একটি প্রাণবন্ত বিদ্যালয়। সংকল্প, “আমি চাই—আমার গ্রাম আলোকিত হোক জ্ঞানের আলোয়, সাহিত্যচর্চায়, পাঠাভ্যাসে। আমি স্বপ্ন দেখি, আমার পাঠাগার হবে গ্রামের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সত্যিকারের দিশারী।” আমার অনুরোধ দেশের কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, প্রশাসকসহ সকল সচেতন নাগরিকদের সার্বিক সহায়তার জন্য, যেন এই আলো আরও দূর পৌঁছায়। উপসংহার: পাঠাগারই হোক সমাজ গঠনের হাতিয়ার— গ্রামের এক কোণ থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। হারুন অর রশিদ স্মৃতি পাঠাগার কেবল একটি পাঠাগার নয়, এটি একটি আন্দোলন—জ্ঞানচর্চার, মানবিক বিকাশের, সমাজ উন্নয়নের। এই পাঠাগার প্রমাণ করে, উদ্যোগ আর আন্তরিকতা থাকলে ছোট পরিসরের কিছু থেকে গড়ে তোলা যায় মহৎ কিছু। আসুন, আমরা সবাই এই পাঠাগারের পাশে দাঁড়াই—সহযোগিতা করি বই দিয়ে, চিন্তা দিয়ে, সময় দিয়ে। কারণ জ্ঞানের আলো যখন ছড়ায়, তখন অন্ধকার নিজে থেকেই সরে যায়। সভাপতি মোঃ মহিউদ্দিন কবি, সাহিত্যিক, প্রফেসর